মুসাফির রাফি
বিষয়টা খুব গোলমেলে হলেও এটাই বাস্তবতা যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলন নিয়ে যে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে তার চেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের আন্দোলন নিয়ে। এক কথায় বলতে গেলে এটা সাধারন মানুষের আন্দোলনে পরিনত হয়েছে। সরকার বাহাদুর হয়তো বিষয়টাকে ততটা পাত্তা দেননি, তবে ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকুরীর বেলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বস্তাপঁচা কোটা পদ্ধতি যে মানুষ আর মেনে নিতে পারছেনা তা কিন্তু পরিস্কার।
সরকারী চাকুরীতে কোটা পদ্ধতির প্রচলন হয় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনও ছিল। মুলত চাকুরী নিয়োগের বেলায় দেশের সব জেলা এবং সব জনগোষ্ঠী যেন সমান সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার জন্যই কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরে বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে, নদীতে অনেক ঢেউ বয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি আর সেই জায়গায় নেই। দেশের শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে বেকারত্বও। এমতাবস্থায় সেই সেকেলে কোটা পদ্ধতি আর সময়ের চাহিদা পূরন করতে পারছিলনা।
এই বাস্তবতায় ২০০০ সালের জুন মাসে গঠন করা হয় পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মস কমিশন। এই কমিশন বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে নিজেদের অসন্তোষও জানায়। কমিশন অবশ্য এই মতামত দেয় যে, কোটা পদ্ধতি সাংবিধানিকভাবে সঠিক একটি ব্যবস্থা তবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রেই কেবল এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। তবে বিদ্যমান সংকট দূর করার ক্ষেত্রে এই কোটা পদ্ধতি খুব একটা কার্যকর সমাধানও নয় বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি এবং নারী কোটার নির্ধারনের ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশমালাও প্রদান করেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে অতীতের কোন সরকার কিংবা বর্তমান সরকারও এই বিষয়ে কোন কার্যকর উদ্যেগ গ্রহন করেনি। প্রতিটি সরকারই তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্যই কোটা পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছে এবং এখনো করছে।
আসলে আমাদের দেশে যে কোটা পদ্ধতি, তা আসলে একদিনে আবির্ভুত হয়নি। এটি আসলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অসুস্থ পরিনতি। সরকারগুলো তাদের জনপ্রিয়তা হারানো এবং বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীর সমর্থন হারাবার ভয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বোঝার পরও এখন পর্যন্ত কোটা পদ্ধতির সংস্কারে হাত দেয়নি। তবে তাদের বোঝা উচিত যে, আগে যেভাবে কোটা পদ্ধতির ব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করে তারা ফায়দা হাসিল করতে পেরেছে বর্তমানে তা আর সম্ভব নয়। অন্তত সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনই সেই ইংগিতই বহন করে।
অতীতে ৭০ এবং ৮০’র দশকে থাকা সরকারগুলো মেধাভিত্তিক কোটা প্রথমে ২০ থেকে ৪০ এবং তারও পরে ৪৫ শতাংশে উন্নীত করেছিল। বর্তমান সরকারকেও অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে সরকারী চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত কি কোটা হবে নাকি মেধা?
সাম্প্রতিক এক গবেষনায় জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যে কয়জন নিয়োগ পাওয়ার কথা, তার অর্ধেকও এখন খুঁজে পাওয়া যায়না। ফলে এই কোটার নির্ধারিত হারের অর্ধেকই আসলে খালি পড়ে থাকে। এই প্রেক্ষিতে সরকারী কর্ম কমিশনও ইদানিং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার ঘোর বিরোধীতা করেছে। অন্যদিকে জেলা কোটা এবং অন্যন্য নানা সেক্টরের জন্য কোটা বরাদ্দ থাকার জন্য ভাল, যোগ্য ও মেধাবীরা চাকুরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই জেলা কোটাও উঠিয়ে দেয়া সময়ের অপরিহার্য দাবী।
কোটা পদ্ধতি বহাল থাকার কারনে আমলাদের দুর্নীতিও বেড়ে যাচ্ছে। চাকুরীর শুরুতে জেলা কোটায় নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদেরকে নিজেদের জেলাকোটা দাবীর বৈধতা প্রমান করার জন্য জেলার তরফ থেকে আবাসিক সনদপত্র জমা দিতে হয়। অথচ এমন অনেকেই আছে, যারা সেই জেলার বাসিন্দাই নয়। তারা বিভিন্ন অসৎ উপায়ে এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে সেই সনদপত্র যোগাড় করে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাগুলোকেও অপব্যবহার করা হচ্ছে বলে অহরহ সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
মেধা থাকার পরও একজন মানুষ চাকুরী পাচ্ছেনা, ফলশ্রুতিতে দেশের বেকারত্বের হারও বেড়ে যাবে- এটা আর মেনে নেয়া যায়না। তাই সরকারকে আন্দোলনকারী সাধারন জনতার ভাষা বুঝতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশমালা অনুযায়ী কোটা পদ্ধতির আমুল সংস্কার এখন সময়ের দাবী।