মুসাফির রাফি
অসংখ্য নবী, সাহাবী ও আউলিয়াদের স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যভুমি সিরিয়া এখন আক্ষরিক অর্থেই একটি ধ্বংসস্তুপ। সিরিয়াতে বিগত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যে তথাকথিত বিদ্রোহীরা সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, বলা হচ্ছে তাদের সর্বশেষ ঘাটি হলো দেশটির পূর্বাঞ্চলের ঘোতা নামক এলাকায়। রাজধানী দামেস্কসহ দেশের একটি বিরাট অঞ্চল থেকে এই বিদ্রোহীদের সরিয়ে দেয়ার পর আসাদ সরকার তাই মনোনিবেশ করেছে এই এলাকাতেই। মনোনিবেশ মানে অহিংস কোন পদক্ষেপ নয় বরং ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ, বর্বরতম সামরিক অভিযান।
সিরিয়ান সামরিক বাহিনী আজ প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত পূর্ব ঘোতায় আকাশ থেকে বিপুল হারে বোমা বর্ষন করছে, আবার স্থলপথেও ব্যপক ধরনের গোলা বর্ষন চালাচ্ছে। অসংখ্য শিশু ও নারীসহ অগনিত বেসামরিক নাগরিক এই বর্বরোচিত হামলায় নিহত হয়েছে ইতোমধ্যেই। এর বাইরে গৌতা শহরে থাকা ৪ লাখ নিরীহ নাগরিক এখন আটকা পড়েছে, যারা এখন প্রতি মুহুর্তেই জীবন মৃত্যুর দোলাচলে দুলছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই সহিংসতা ঠেকাতে কার্যকর কিছুই করতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার অনুরোধে আজ মঙ্গলবার গৌতায় ৫ ঘন্টার একটি যুদ্ধবিরতি দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধবিরতির সময়টুকুর মধ্যেই বেসামরিক নাগরিকেরা যেন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু বিধি বাম। এর মধ্যে যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করেই সরকারী বাহিনী আবার সামরিক অভিযান শুরু করে দিয়েছে এবং সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী দুজন বেসামরিক নাগরিক এই সামরিক হামলায় নিহত হয়েছেন।
মূলত ২০১৩ সাল থেকেই গৌতা শহরটিকে সিরিয়ান সেনারা অবরোধ করে রেখেছেন। তারা জানতেন, এই গৌতাই বিদ্রোহীদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি। তারপরও রাশিয়ার সমর্থন প্রাপ্তি এবং নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে একবারে মাঠে নামার উদ্দেশ্যেই বাশার সরকার ৫ বছর সময় নিয়ে এই অভিযানটি শুরু করে। দীর্ঘ অবরোধের কারনে ইতোমধ্যেই গৌতায় প্রচন্ড খাবার এবং ঔষধের সংকট দেখা দেয়। শিশুরাও সেখানে প্রচন্ড অপুষ্টিতে ভুগছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এর আগে ২০১৭ সালে রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক এই গৌতা অঞ্চলকে ‘ডি-এসকেলশন’ জোন হিসেবে ঘোষনা করে যার ফলে এই অঞ্চলের উপর দিয়ে রাশিয়া বা সিরিয়ার কোন যুদ্ধ বিমান চলতে পারতোনা।
এমতাবস্থায় রাশিয়ান বিমান বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সিরিয়ার সামরিক বাহিনী গত ১৯ ফেব্রুয়ারী থেকে গৌতা এলাকায় স্মরনকালের জঘন্যতম সামরিক অভিযান শুরু করে। প্রথম দুদিনের গোলা বর্ষনেই কয়েকশ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল আসাদ বাহিনীর এই বোমা বর্ষনকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করেছে কেননা বিদ্রোহীদের দমনের কথা বলা হলেও এই সামরিক অভিযান ও বিমান হামলায় এই পর্যন্ত ৬টি হাসপাতাল ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। জাতিসংঘ এতদিন কিছু না করতে পারলেও ২৫ ফেব্রুয়ারী একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব অনুমোদন করে যেখানে ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখার ঘোষনা দেয়া হয়। কিন্তু তা স্বত্বেও সিরিয়ার সামরিক বাহিনী পূর্ব গৌতায় তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। সামরিক সদস্যরা ক্লাস্টার বোমা, বাংকার বোমা বিস্ফোরন এবং মর্টার শেলসহ সব ধরনের সামরিক অস্ত্র ব্যবহার করছে। এমনকি গৌতায় কর্মরত বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার সদস্যরা অভিযোগ করছেন যে, আসাদ বাহিনী গৌতায় বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসও নিক্ষেপ করেছে এবং ইতোমধ্যেই সেখানকার বাতাসে বিষাক্ত টক্সিক ক্লোরিন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। সিরিয়া সরকার এই গ্যাস প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে খোলাসা না করলেও সিরিয়ার ঘনিষ্ট মিত্র দেশ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভ এই গ্যাস প্রয়োগের অভিযোগকে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সিরিয়া সরকার এই গৌতায় এভাবে অভিযান চালাচ্ছে কেননা দেশটির ভৌগলিক মানচিত্রে গৌতার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। গৌতা অঞ্চলটি রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। তাই এই এলাকাটিকে বিদ্রোহীমুক্ত না করা গেলে আসলে সিরিয়ার আসাদ সরকার নিজেদেরকে ঝুঁকিমুক্ত ভাবতেই পারছেনা। কিন্তু এই গৌতায় আক্রমনটি অন্য যে কোন এলাকার সামরিক অভিযানের তুলনায় বিশ্ববিবেককে একটু বেশী নাড়া দেয়ার কারন হলো এই শহরে যে ৪ লাখ বেসামরিক লোক বসবাস করে তার অর্ধেকেরও বেশী নাগরিকের বয়স ১৮’র কম। বিশেষত গৌতায় শিশুর সংখ্যা অন্য যে কোন শহরের চেয়ে অনেক বেশী। আরব বসন্তের অনিবার্য পরিনতি হিসেবে সিরিয়াতে ৮ বছর আগে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এই পর্যন্ত তাতে নিহতের সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার জন। আর গৃহহীন বা উদ্বাস্তুতে পরিনত হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
বেসরকারী সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরী ফর হিউম্যান রাইটস’র হিসাবে গৌতায় আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৬২১ জন বেসামরিক মানুষ। এর মধ্যে ১৮৫ জন শিশু আর ১০৯ জন নারী। সিরিয়ান সরকার অবশ্য বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার বিষয়টি অস্বীকার করছেনা তবে তারা দাবী করছেন বিদ্রোহীরা এই বেসামরিক নাগরিকদেরকে প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করায় আসলে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
আসলে সিরিয়া সরকার যাই বলুক বা দাবী করুক না কেন, কোন অবস্থাতেই নিরীহ শিশু ও নারীদের নির্বিচারে হত্যার বিষয়টি মানা যায়না। সিরিয়া দেশটি ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ন। আমরা সারা বিশ্বের মুসলমানেরা এভাবে আমাদের নিরীহ মুসলিম ভাই-বোনদের হত্যা করার বিষয়টি অবলোকন করছি- এটা মানা যায়না। গোটা বিশ্বের বিবেক তথা শান্তিকামী মানুষের দাবী এখন একটাই, অবিলম্বে গৌতায় সিরিয়ার সরকারী সামরিক বাহিনী ও সিরিয়ার মিত্র রাশিয়ানদের বর্বর গনহত্যা বন্ধ করতে হবে। নতুবা হিটলার বা হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা ফেলা সেই ঘৃন্য মানুষগুলোর তালিকায়, কিংবা চেঙ্গিস বা হালাকু খানের মত বর্বর গনহত্যাকারীদের তালিকায় স্থায়ীভাবে বাশার আল আসাদের নাম উঠে যাবে।
পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের নির্যাতিত মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য ক্রন্দন করাই হয়তো আমাদের মত অক্ষম মুসলমানদের সম্ভাব্য কর্মকৌশল। তবে আমরা যদি গৌতার সেই নিহত শিশু আর তাদের অসহায় মা’দের চোখের পানিকে মুছে দিতে না পারি তাহলে মুসলমান হিসেবেও আমরা জবাবদিহি করতে পারবো কিনা সন্দেহ।
আল্লাহ তায়ালা যেন সিরিয়া ও গৌতাকে হেফাজত করেন, তার নেয়ামতের নিদর্শন হিসেবে সেখানকার নিরীহ ও মজলুম মানবতার জন্য জলদি যেন ত্রানকর্তা হিসেবে কাউকে পাঠান। আমিন।