অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে দেয়া বক্তব্যকে বিকৃত করে রায় প্রদান করেছেন বিচারপতি আখতারুজ্জামান। ১৯ ফেব্রুয়ারি মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের কাছে পৌঁছার পর বক্তব্য বিকৃতির এই তথ্য বেরিয়ে আসে।
বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবিরা বরাবরই বলে আসছিলো জাল জালিয়াতি আর নথি ঘষামাজা করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার চার্জশীট তৈরি করা হয়েছে। এখন মামলার রায়ে খালেদার বক্তব্যকে বিকৃত করার তথ্য প্রমাণ হওয়ায় তারা বলছেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই মামলার পুরো কার্যক্রমটিই হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে, যা আবারও প্রমাণীত হলো।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া কয়েকদিন ধরে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে খালেদা জিয়া আদালতে লিখিতভাবে বর্তমান সরকারের দুর্নীতি ও টাকা পাচারসহ নানা অপকর্মের চিত্র তুলে ধরেন।
লিখিত দীর্ঘ বক্তব্যের এক যায়গায় খালেদা জিয়া বলেছেন, “ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিভিন্ন ধর্মের লোক, এমনকি বিদেশীরা খুন হচ্ছেন। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কোথাও কারো কোনো নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে নির্বিচারে গুলি করে প্রতিবাদী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়? ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি?”
আদালতে খালেদা জিয়া বিচারকের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি?’। এই বাক্যের শেষে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যটি প্রশ্নবোধক চিহ্নসহ দৈনিক নয়াদিগন্ত, মানবজমিনসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্র পত্রিকায় হুবহু প্রকাশিত হয়। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টেও বিচারকের সামনে খালেদা জিয়ার উচ্চারণ ‘ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি?’ বাক্যটির শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল।
কিন্তু যখন ১৯ ফেব্রুয়ারী রায়ের সার্টিফায়েড কপি প্রকাশিত হয় তখন দেখা যায় খালেদা জিয়ার প্রশ্ন “ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি?” এই বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্নটি বিচারক তুলে দিয়েছেন। প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলে দিলে বাক্যটি দাঁড়ায় “ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি”। যার মাধ্যমে খালেদার বক্তব্যের পুরো অর্থকেই উল্টে দেয়া হয়েছে।
বাক্যটি নিজেদের ইচ্ছেমতো সাজিয়ে বিচারক রায়ে লিখেছেন, “আদালত মনে করেন আসামি বেগম খালেদা জিয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার বিধান মোতাবেক আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য প্রদানের সময় নিজ জবানিতে স্বীকার করেছেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন”।
এভাবেই খালেদা জিয়ার প্রশ্নবোধক বাক্যকে সাধারণ বাক্য বানিয়ে বিচারক লিখেন ‘খালেদা জিয়া নিজেই অপরাধ স্বীকার করেছেন’!
রায়ে বিচারকের এমন জালিয়াতিতে হতভম্ব হয়েছেন দেশের আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, এটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে যে, আদালতে প্রদানকৃত আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্যকে এভাবে ইচ্ছেকৃত বিকৃত করে আদালত রায় প্রদান করেছে। তাও আবার একজন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করে! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গায়েল করতে আদালতকে এমন ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করায় সরকারের প্রতিও ধিক্কার জানান তারা।
সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের উপর সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের ব্যপারটি বর্তমানে খুব নগ্নভাবে দেখা দিয়েছে। সরকারের মতের বাইরে কোনো রায়ই প্রদান করতে পারেন না বিচারকরা। মতের বাইরে যাওয়ায় আমরা দেখেছি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে জোরপূর্বক পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানকে অর্থ পাচারের একটি অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেয়ায় ওই বিচারককেও দেশত্যাগ করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব খারাপ নজির মানুষকে আদালতের প্রতি আস্থাহীন করে তুলছে। খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের ক্ষেত্রে এখন নতুন করে যেই জালিয়াতির ব্যপার ধরা পড়লো তাতে করে আর আদালতকে স্বাধীন বলার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট রাইলো না।