অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত ছাত্রসংগঠন হলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। খুন-হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ভর্তি বাণিজ্য ও প্রশ্ন ফাঁসসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘঠিত হচ্ছে না।
এবার সব কিছুকে ছাপিয়ে সামনে এসেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাদক ব্যবসা। এতদিন অভিযোগ ছিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই মাদক সেবন করে। মাদক সেবন অবস্থায় বিভিন্ন সময় তারা পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হচ্ছে। এখন জানা গেছে, তারা শুধু নিজেরা মাদক সেবনই করে না, মাদক ব্যবসাও চলে তাদের নিয়ন্ত্রণেই।
আর অভিযোগও বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে নয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে করা মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে কয়েক ডজন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতার নাম। আর এই মাদক কেনাবেচার নিরাপদ স্থান হিসেবে তারা ব্যবহার করছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের আবাসিক হলগুলো। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলকে তারা এখন মাদকের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৩৮ জনের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২০ জন হলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে যুবলীগের দুজন নেতা রয়েছে।
এই তালিকায় দেখা গেছে, মাদক ব্যবসায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে আটজন ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, দুজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক নেতা, পাঁচজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী এবং দুজন ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক শীর্ষস্থানীয় নেতা।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তিন সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, নাজমুল হক ও নিশীতা ইকবাল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান ওরফে সেতু ও দারুস সালাম ওরফে শাকিল, আপ্যায়ন সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ওরফে রাশেদ, উপ পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সোহাগ ও উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহাবুবুল ইসলাম ওরফে প্রিন্স।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক এহতেশামুল হাসান ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ওয়াসিম ভূঁইয়ার নামও রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগের মুহসীন হল শাখার সাবেক সহসম্পাদক মো. রাসেল উদ্দিনকে তাঁর হলের কক্ষ থেকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর সাত দিন পর ফজলুল হক মুসলিম হলের একটি কক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ মদ, বিয়ারসহ গ্রেপ্তার করা হয় পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সৈকত বাশারকে। সৈকতের সঙ্গেই তৎকালীন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মাহমুদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলামকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাশেদ ও সাইফুলকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা ক্যাম্পাসে মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাঁদের নাম নেই।
এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় শহীদুল্লাহ্ হল শাখার সাবেক সহসভাপতি লিজামুল হক, মুহসীন হলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আপেল মাহমুদ, ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধু হল শাখার সহসম্পাদক কামরুজ্জামান, শহীদুল্লাহ্ হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসানের নাম মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
তালিকায় নাম আসায় শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের পরিবেশ বিষয়ক উপ-সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেছেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সোহাগ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই জরিপ কোনভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এটি যদি সত্যিকারের ও সঠিক কোন অনুসন্ধান হতো, তাহলে আমার নাম এই তালিকায় থাকতো না। বরং আরো অন্যান্য নাম থাকতো। যারা প্রকৃতপক্ষে এসব কাজে জড়িত। এটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। আমি অনেকের পরিচয় জানি। তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতারা আছেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের করা এই তালিকা দেখে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি মানুষ সরকারের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভও প্রকাশ করছেন। অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে তার সোনার ছেলে ছাত্রলীগকে দিয়ে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন আর অপরদিকে সংসদে দাড়িয়ে মাদকের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন!
কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা এখন ছাত্রলীগের মাদকের গোডাউন।