অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
‘মাননীয় আদালত, এই মামলার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাৎ। কিন্তু কোনো টাকা তো খরচই হয়নি। সব টাকা ব্যাংকে আছে। সুদে-আসলে তা বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। তাহলে আত্মসাৎ হলো কীভাবে? হোয়াট ইজ আত্মসাৎ? আর আত্মসাৎ যদি না হয়, তাহলে মামলা কিসের?’
আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী আহসান উল্লাহ্ সম্প্রতি আদালতে এভাবেই মামলাটির অসাঢ়তা তুলে ধরেছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবির এমন মন্তব্য সবাইকে অবাক করেছে। যেই মামলায় একজন তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে এবং সরকার পক্ষও মামলার অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে বলে দাবি করছেন সেখানে খালেদার আইনজীবির এমন বক্তব্যের মানে কি?
আসুন আমরা জেনে নেই খালেদা জিয়ার এই আলোচিত মামলার আপাদমস্তক। আসলেই কি কোনো দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া? নাকি শুধুমাত্র রাজনৈতিক হয়রানির জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যাভাবে তার উপর এই অপবাদ আরোপ করা হয়েছে? শেখ হাসিনার প্রায় সব বক্তব্যে খালেদার এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার যেই গল্প শোনানো হয় সেটার সত্যতা আসলে কতটুকু? আসুন এই মামলার একটি পোষ্টমর্টেমের মাধ্যমে সত্যটুকু জেনে নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার এই পোষ্টমর্টেমটি করেছেন জামিল সিকদার সাজ্জাদ।
সবার আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার এজাহারটি মনোযোগ দিয়ে পড়া যাক।
বরাবর,
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
রমনা মডেল থানা
ডিএমপি,ঢাকা।
বিষয়ঃএজাহার দায়ের।
আমি হারুনুর রশীদ,উপ-সহকারি পরিচালক,দুর্নীতি দমন কমিশন,প্রধান কার্যালয়,ঢাকা এই মর্মে এজাহার করছি যে,দুদক নথি নং-৬৬/২০০৮ (অনু: ও তদন্ত-৩) এর অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে,সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ সময়কালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ডিডি নং-১৫৩৩৬৭৯৭০ তারিখ ০৯/০৬/১৯৯১ ইং মূলে কুয়েতের আমীর এর পক্ষ থেকে ১২৫৫০০০ ইউ এস ডলার, যা তৎকালীন রেটে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৪৪৮১২১৬ টাকা অনুদান/সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত হন।তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামীয় একটি পৃথক তহবিল গঠন করেন(যা পূর্বে ছিল না এবং পরবর্তীতেও এর কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় নি)। এবং সোনালী ব্যাংক,রমনা শাখায় প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামীয় একটি চলতি হিসাব খুলে (যার হিসাব নং ৫৪১৬) উক্ত অনুদান সাহায্য বাবদ প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ সেখানে জমা করেন।পরবর্তীতে তিনি সরকারি তহবিলে বিদ্যমান উক্ত অর্থ অসৎ উদ্দেশ্যে আত্মসাতের অভিপ্রায় প্রথমে নিজ পুত্রদ্বয় যথাক্রমে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান এবং স্বামী মরহুম জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমানকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেন, যা ০৫/০৯/১৯৯৩ইং তারিখে গুলশান সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশন নং iv ৩০ মূলে রেজিস্ট্রি হয় এবং উক্ত ট্রাস্টের ঠিকানা ৬ , শহীদ মইনুল রোড,ঢাকা সেনানিবাস,ঢাকা উল্লেখ আছে।যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বসবাস করতেন।তারেক রহমান , পিতা- মরহুম জিয়াউর রহমানকে দি অথর অব দি ট্রাস্ট তথ্যাদি সেটেলর নিয়োগ করা হয়। উক্ত ট্রাস্টটির ডিড অব ট্রাস্টের ১৪ নং অনুচ্ছেদ মূলে (১) তারেক রহমান, (২)আরাফাত রহমান উভয়ের পিতা মরহুম জিয়াউর রহমান । এবং (৩) মমিনুর রহমান , পিতা-মৃত মমতাজুর রহমান সম্ন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠন করা হয়।বিগত ১৩-১১-১৯৯৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের সোনালী ব্যাংক, রমনা কর্পোরেট শাখার চলতি হিসাব নং ৫৪১৬ (বর্তমানে ৭১০৫৪১৬৪) এর চেক নং ৮৪৩১১০৩ তারিখ ১৩-১১-১৯৯৩ ইং মূলে উক্ত অনুদানের অর্থ হতে ২৩৩৩৩৫০০ টাকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বগুড়ায় একটি এতিমখানা স্থাপনের নামে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অনুকূলে প্রদান করা হয়। উক্ত চেকটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামীয় সোনালী ব্যাংক, গুলশান নিউ নর্থ সার্কেল শাখার এসটিডি হিসাব নং – ৭ এ গত ১৫- ১১-১৯৯৩ ইং তারিখে জমা হয়।উক্ত একাউন্ট হতে বিগত ০৪-১১-১৯৯৩ ইং তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০১ এর মাধ্যমে ৪০০০০০ টাকা উত্তলন করা হয়।অতঃপর সেই টাকা হতে বগুড়া জেলার গাবতলী থানাধীন দাড়াইল মৌজায় ১৭টি দলিল মূলে ২৭৭০০০ টাকা দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর নামে ২.৭৯ একর জমি ক্রয় করা হয়।অবশিষ্ট টাকা দিয়ে ১৯৯৩ সন থেকে ২০০৬ সনের মধ্যে কোন এতিমখানা স্থাপন না করে এবং এতিম ও দুঃস্থদের কল্যাণে ব্যয় না করে ট্রাস্টের নামীয় উক্ত একাউন্টে অব্যয়িত রাখা হয়। যার স্থিতি ১২ -০৪-২০০৬ ইং পর্যন্ত সময়ে সুদ আসলে ৩৩৭০৯৭৫৭/৩২ টাকা দাঁড়ায়। অতঃপর ব্যাংকে জমা থাকা টাকা উক্ত হতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সেটেলর ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আসামী তারেক রহমান এবং ট্রাস্টি বোর্ডের অপর সদস্য মমিনুর অসৎ উদ্দেশ্যে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে ১৩-০৪-২০০৬ তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০৭ মূলে ৫০০০০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা, ১৫-০৫-২০০৬ তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০৪ এবং চেক নং ৪৮৮২৪০৬ মূলে প্রতিটি এক ১০০০০০০০ (এক কোটি) করে ২০০০০০০০ (দুই কোটি) টাকা, ০৪-০৭-২০০৬ ইং তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০৪ মূলে ৫০০০০০০ ( পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা এবং ০৫-০৭-২০০৬ ইং তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০৩ মূলে ৩০০০০০০ ( ত্রিশ লক্ষ) টাকা সর্বমোট ৩৩০০০০০০ ( তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ) টাকা প্রাইম ব্যাংক, গুলশান শাখায় এফডিআর হিসাব খোলার নামে নগদায়ন / স্থানান্তর করে।
উক্ত টাকার মধ্যে ১৩-০৪-২০০৬ তারিখের ৫০,০০,০০০ টাকার চেকটি নগদায়ন করে প্রথমে কাজী হক-এর ব্যক্তিগত নামে একটি এফডিআর যার নং ৪১০২৯৪৬২ হিসাব খোলা হয়।পরবর্তীতে গত ১৬-০৭-২০০৬ ইং তারিখে উক্ত এফডিআরটি নগদায়ন করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর নামে সুদসহ ৫০,৬৮,৪৫০ টাকার একটি নতুন এফডিআর খোলা হয়। যার নং ৪১০৩৩৩৩৮।এছাড়াও অপর চেক সমুহের অর্থ দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে ৮০,০০,০০০ ( আশি লক্ষ) টাকার একটি এফডিআর, যার নং ৪১০৩৩১১৭ তারিখ ০৯-০৭-২০০৬ ও ১,০০,০০,০০০ ( এক কোটি) টাকার একটি এফডিআর, যার নং ৪১০৩২৬৬৯ তারিখ ২৭-০৬-২০০৬ খোলা হয় । অবশিষ্ট ১,০০,০০,০০০ ( এক কোটি) টাকা দিয়ে কাজী সলিমূল হক এর ব্যক্তিগত নামে একটি এফডিআর খোলা হয়, যার নং ৪১০৩২২৭৬ তারিখ ১৫-০৬-২০০৬।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের ২৮-০৩-২০০৬ তারিখের কথিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামীয় ৫০,০০,০০০ টাকার ও ৮০,০০,০০০ টাকার এফডিআর দুটি পরিচালনার জন্য জনৈক এম এস রহমানকে এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে খোলা ১,০০,০০,০০০ ( এক কোটি) টাকার অপর একটি এফডিআর ও কাজী সলিমূল হক – এর ব্যক্তিগত নামে খোলা ১,০০,০০,০০০ ( এক কোটি) টাকার এফডিআরটি পরিচালনার জন্য কাজী সলিমুল হককে ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
বর্ণিত ৪টি এফডিআর এর মধ্যে ৫০,০০,০০০ টাকা ও ৮০,০০,০০০ টাকার এফডিআর দুটি প্রাইম ব্যাংক, গুলশান শাখায় চলমান আছে। তবে কাজী সলিমুল হকের মৌখিক নির্দেশে এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর ট্রাস্টি বোর্ডের কথিত ১৫-১০-২০০৬ তারিখের সভার সিদ্ধান্তের উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এর নামীয় ১,০০,০০,০০০ ( এক কোটি) টাকার এফডিআর এবং কাজী সলিমুল হক এর ব্যক্তিগত নামে খোলা ১,০০,০০,০০০ (এক কোটি) এফডিআর দুটি প্রাইম ব্যাংক , গুলশান শাখা হতে আন্তঃব্যাংক ক্রেডিট এডভাইস ( IBCA) এর মাধ্যমে প্রাইম ব্যাংক, নিউ ইস্কাটন শাখায় সুদসহ নগদায়ন / স্থানান্তর করে কাজী সলিমুল হক ও সৈয়দ আহমেদ ওরফে সায়িদ আহমেদ এর যৌথ নামে ১৬- ১১ -২০০৬ তারিখে একটি এফডিআর যার নং ৪১০২২৬১৯ /৭৩১৯৩ টাকার পরিমাণ ১,০৩,১৯,৩৬৫ খোলা হয় এবং গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এর নামে ০৭-০২-২০০৭ তারিখে অপর একটি এফডিআর , যার নং ৪১০২৫৫৩৫/৭৩৪১৯ টাকার পরিমাণ ১,০৬,৩৮,৬৮৬ খোলা হয়।উক্ত ২ টি এফডিআর এর মধ্যে ১৬-১১-২০০৬ তারিখে কাজী সলিমুল হক ও সৈয়দ আহমেদ ( সায়িদ আহমেদ) এর যৌথ নামে খোলা এফডিআর, যার নং ৪১০২২৬১৯/৭৩১৯৩ তুলে সুদসহ নগদায়ন করে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এর নামে একটি নতুন এফডিআর , যার নং ৪১০২৫৫১১/ ৭৩৪৩৯ তারিখ ০৭-০২-২০০৭ টাকার পরিমাণ ১,০৪,৩২,৯৫৭/৮০ খোলা হয়।
অতঃপর আসামি গিয়াসউদ্দিন আহমেদ উক্ত এফডিআর দুটি নগদায়ন করে একই ব্যাংকে বিগত ১৫-০২-২০০৭ ইং তারিখে তার নিজ নামে ৬ টি পে-অর্ডার , যথাক্রমে পে-অর্ডার নং ৬৫৯৩৪৮ টাকার পরিমাণ ৪০,০০,০০০, পে-অর্ডার নং ৬৫৯৩৪৯ টাকার পরিমাণ ৪০,০০,০০০, পে-অর্ডার নং ৬৫৯৩৫০ টাকার পরিমাণ ৩০,০০,০০০, পে-অর্ডার নং ৬৫৯৩৫১ টাকার পরিমাণ ৩০,০০,০০০ পে-অর্ডার নং ৬৫৯৩৫২ টাকার পরিমাণ ৫০,০০,০০০ এবং পে – অর্ডার নং ৬৫৯৩৫৩ টাকার পরিমাণ ২০,৭১,৬৪৩/৮০ ইস্যু করেন এবং একই ব্যাংকের একই শাখায় জনৈক শরফুদ্দিন আহমেদ এর নামীয় চলতি হিসাব নং ১১০১৩১৪ এ জমা করেন, যা উক্ত ব্যাংক হিসাবে গত ২৮-০৩-২০০৭ তারিখে জমা হয়।পরবর্তীতে আসামি শরফুদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য উৎস হতে তার উক্ত চলতি হিসাবে জমাকৃত টাকার সাথে উক্ত ২১০৭১৬৪৩/৮০ টাকা উত্তোলন করেন এবং পরস্পর যোগসাজশে তা আত্মসাৎ করেন।
উপর্যুক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসৎ উদ্দেশ্যে উপোল্লিখিত সুপরিকল্পিত পন্থায় আত্মসাতের অভিপ্রায়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের এবং তার স্বামীর বোনের ছেলে মমিনুর রহমানকে দিয়ে তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের নামে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করে ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাবলে তার নিজস্ব পরিচালনাধীন প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল থেকে ২,৩৩,৩৩,৫০০ টাকা উক্ত ট্রাস্ট প্রদান করে এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সেটেলর তারেক রহমান উক্ত ট্রাস্টি বোর্ডের অপর সদস্য মমিনুর রহমান এর সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে ট্রাস্টের সাথে সম্পর্কহীন কাজী সলিমুল, সৈয়দ আহমেদ ওরফে সায়িদ আহমেদ,গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং শরফুদ্দিন আহমেদ এর সহযোগিতায় নিজে অথবা অন্যকে অবৈধভাবে লাভবান করার মানসে অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গ করে আত্মসাতের অভিপ্রায়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামীয় ২,০০,০০,০০০ ( দুই কোটি) টাকা , যা সুদসহ ২,১০,৭১,৬৪৩/৮০ টাকা আত্মসাত করে আত্মসাত করায় সহযোগিতা করে বাংলাদেশ দঃবিঃ ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ ২ নং আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধ করায় (১) বেগম খালেদা জিয়া , সাবেক প্রধানমন্ত্রী , স্বামী মরহুম জিয়াউর রহমান, ঠিকানা-৬,শহীদ মইনুল রোড, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।(২) তারেক রহমান, পিতা- মরহুম জিয়াউর রহমান,ঠিকানা-৬, শহীদ মইনুল রোড, ঢাকা সেনানিবাস ,ঢাকা। (৩) মমিনুর রহমান , পিতা -মৃত মমতাজুর রহমান তরফদার , ঠিকানা- ২১৩,এলিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি (নিউ মার্কেট থানা), ঢাকা।বর্তমান ফ্ল্যাট নং ৫০২, প্লট নং -৮/এ রোড, নং -৪, গুলশান-১, ঢাকা। (৪) কাজী সলিমুল হক, ওরফে কাজী কামাল, সাবেক বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য, পিতা- মৃত কাজী আকরামুল হক, ঠিকানা-৭১০ বড় মগবাজার,ঢাকা,বর্তমানে ফ্ল্যাট নং -২/ডি,বাড়ি নং -৫, গোল্ডেন ক্রেস্ট,রোড নং -৮, গুলশান-১।স্থায়ী ঠিকানা-গ্রাম-বামনখালী,থানা-শালিখা,জেলা-মাগুরা, (৫) সৈয়দ আহমেদ ওরফে সায়িদ আহমেদ, পিতা- শরফুদ্দিন আহমেদ, ঠিকানা- ৭১২, বড় মগবাজার,থানা- রমনা,ঢাকা। (৬) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, পিতা -মৃত শাহাব উদ্দিন, ঠিকানা -৭১২ , বড় মগবাজার,থানা – রমনা, ঢাকা। (৭) শরফুদ্দিন আহমেদ, পিতা – মৃত শাহাব উদ্দিন আহমেদ,ঠিকানা- ৭১২ বড় মগবাজার ,থানা- রমনা ,ঢাকা গণের বিরুদ্ধে আপনার থানায় বর্ণিত ধারায় একটি মামলা রুজু করার জন্য অনুরোধ করা হলো।ঘটনার সাথে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে তদন্তকালে তা দেখা হবে।তদন্ত প্রতিবেদনের স্বাক্ষী ও আলামতের বিবরণ দেয়া হবে।দুর্নীতি দমন কমিশন উক্ত মামলার তদন্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
(হারুনুর রশিদ)
উপ-সহকারি পরিচালক (অনুঃ ও তদন্ত-৩)
দুর্নীতি দমন, কমিশন,প্রধান কার্যালয়,ঢাকা।
ঘটনাস্থলঃ প্রাইম ব্যাংক,নিউ ইসকাটন শাখা , রমনা, ঢাকা।
ঘটনার তারিখঃ ১৩-১১-১৯৯৩ হতে ২৮-০৩-২০০৭ইং
এজাহারটি ৩রা জুলাই ২০০৭ সালে দায়ের করা হয়।
এইবার এজাহারটি ব্যবচ্ছেদ করার পূর্বেই ছোট্ট একটি দৃশ্যকল্প কল্পনা করা যাক। মনে করুন আপনাদের গ্রামে এক ব্যক্তি বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সদ্য নির্বাচিত সেই চেয়ারম্যান সাহেবের এক বন্ধু আছেন, যিনি কিনা আমেরিকা প্রবাসী। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাস ছয়েক পর প্রিয় আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত অনুদান পেলেন। টাকাটা যেহেতু চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত একাউন্টে এসেছে, তাই খরচও করবেন ব্যক্তিগত নিয়মে, সরকারি নিয়মে নয়! এই ব্যক্তিগত অনুদান পাওয়া টাকাটা যদি চেয়ারম্যান সাহেব আপনাদের এলাকায় দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করেন তবে আপনি চেয়ারম্যান ও তার প্রিয় বন্ধুর প্রতি খুবই খুশি হবেন। কিন্তু যদি এমন হয় যে, চেয়ারম্যান সাহেব প্রিয় বন্ধুর পাঠানো টাকাটা যেখানে দান করেছেন সেখানকার দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তারা টাকাগুলো আত্মসাত করে থাকেন তবে চেয়ারম্যানের নামে কোন অভিযোগ অথবা মামলা দিবেন কি?
এইবার উপরের দৃশ্যকল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর পরিবর্তে কুয়েতের আমীর, চেয়ারম্যানের জায়গায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জায়গায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট বা অন্য যে কোন ট্রাস্ট…. হোক সেটা বঙ্গবন্ধু মেমরিয়াল ট্রাস্ট কল্পনা করুন। বন্ধু হিসেবে পাওয়া কুয়েতের আমীরের পক্ষ থেকে পাওয়া ১২ লক্ষ ৫৫ হাজার ইউএস ডলার বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ইচ্ছামাফিক ব্যক্তিগতভাবেই ট্রাস্টের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। টাকাগুলো যেসব ট্রাস্টগুলোতে ব্যয় করা হয়েছে, সেসবের একটিও তিনি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন না। তাই ট্রাস্টগুলো পরিচালনার দায় দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাস্টের তহবিলের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর জবাবদিহিতার প্রশ্নই আসে না!
কোথাও দান করার পর সেখানে কোনরূপ দুর্নীতি হলে এর প্রধান দায়ভার যদি দাতাকেই বহন করতে হয় তবে এখন থেকে আপনি বুঝে শুনে মসজিদ, মাদ্রাসা, বন্যাদূর্গত এলাকায় অথবা রোহিঙ্গাদের দান করবেন। তা না হলে যেখানে দান করেছেন সেখানে কোন দূর্নীতির অভিযোগ হলে আপনিই হবেন এক নম্বর আসামী। এইটা আপনি অবাস্তব আর উদ্ভট চিন্তা কল্পনা করলেও বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে ঠিক এমন অন্যায় কাজটাই হয়েছে!
এবার আসা যাক, দুর্নীতি ও টাকা আত্মসাতের প্রশ্নে। গত ১০টি বছর “এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার” দোয়োধ্বনি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। এই উচ্য গলাবাজিতে সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, সত্যিই বোধ হয় দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির এই কালো বিড়ালটা খুঁজতে চাইলে শুধু গলাবাজিতে বিশ্বাস নয়, লেখার বাকি অংশগুলো ধৈর্য্য ধরে পড়ুন প্লিজ! টাকা লেনদেনের দিকে চোখ রাখলেই দুর্নীতি ও টাকা আত্মসাতের চিত্রটা আপনার সামনে ফুটে উঠবে।
এজাহারেই উল্লেখ আছে, কুয়েতের আমীরের পক্ষ হতে ব্যক্তিগত অনুদানে পাওয়া টাকাটা দুইটি চ্যারিটি ফান্ডে ভাগ হয়েছিল। এজাহারে বাগেরহাটে চ্যারিটি ফান্ডে ব্যয় করা টাকাটা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেনি। তবে যে টাকা সম্পর্কে এত অভিযোগ, সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ১৩-১১-১৯৯৩ সালে ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা অনুদান পেয়েছিল। এজাহারেই উল্লেখ আছে, এই টাকাটা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামীয় সোনালী ব্যাংক, গুলশান নিউ নর্থ সার্কেল শাখার এসটিডি হিসাব নং-৭ এ গত ১৫-১১-১৯৯৩ ইং তারিখে জমা হয়। উক্ত একাউন্ট থেকে বিগত ০৪-১১-১৯৯৩ ইং তারিখে চেক নং ৪৮৮২৪০১ এর মাধ্যমে ৪ লক্ষ টাকা উত্তোলিত হয়। সেই উত্তোলিত টাকা দিয়ে বগুড়া জেলার গাবতলী থানার দাড়াইল মৌজায় ১৭টি দলিল মূলে ২ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে ২ দশমিক ৭৯ একর জমি ক্রয় করা হয়েছিল। অবশিষ্ট টাকাগুলো ব্যাংকেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অনুকুলে ব্যাংকেই অব্যায়িত অবস্থায় থাকে এবং তা ১২-৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত সুদে আসলে ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৯ হাজার ৭ শত ৫৭ টাকা ৩২ পয়সা হয়। পরবর্তীতে এই টাকা ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্তে মোট ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার ৫ টি FDR হয়। FDR গুলো জিয়া অরফানেজ এর নামে প্রাইম ব্যাংক গুলশান শাখায় রাখা হয়।
১ম FDR: ৫০ লক্ষ টাকা।
তারিখ: ১৩/০৪/২০০৬; চেক নংঃ ৪৮৮২৪০৭
২য় FDR: ১ কোটি টাকা।
তারিখ: ১৫/০৫/২০০৬; চেক নংঃ৪৮৮২৪০৪
৩য় FDR: ১ কোটি টাকা।
তারিখ: ১৫/০৫/২০০৬; চেক নংঃ ৪৮৮২৪০৬
৪র্থ FDR: ৫০ লক্ষ টাকা।
তারিখ: ০৪/০৭/২০০৬; চেক নংঃ ৪৮৮২৪০৮
৫ম FDR: ৩০ লক্ষ টাকা।
তারিখ: ০৫/০৭/২০০৬; চেক নংঃ ৪৮৮২৪০৩
এইবার পর্যায়ক্রমে এসব FDR এর টাকাগুলোর পরবর্তী গন্তব্য পর্যবেক্ষন করি।
উপরে উল্লেখিত ৫ টি FDR এর প্রথমটি অর্থাৎ ১৩/০৪/২০০৬ তারিখের ৫০ লক্ষ টাকার FDR টি কাজী সলিমুল হককে দায়িত্ব দিয়ে তার নামে একটি ব্যক্তিগত FDR নগদায়ন করা হয়।পরবর্তীতে তার নামে করা এই ব্যক্তিগত FDR টি ১৬/০৭/২০০৬ তারিখে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে পুনয়ায় নগদায়ন করা হয়।এছাড়াও উপরে আলোচিত ৪র্থ ও ৫ম FDR ২ টি একত্র করে ৯/৭/২০০৬ সালে ৮০ লক্ষ টাকার ১ টি FDR জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামেই খোলা হয়। পরবর্তিতে ৫০ লক্ষ টাকা ও ৮০ লক্ষ টাকার দুই টি পৃথক FDR দুইটি এস. এম রহমানের নামে ব্যক্তিগত দুইটি FDR খোলা হয় এবং তাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। উক্ত FDR দুইটি গুলশান শাখায় মামলা করা মুহুর্ত পর্যন্ত তখনও চলমান ছিল। এই ফাঁকে একটি কথা সবাইকে জানিয়ে রাখি, ট্রাস্টের দুইটি FDR পরিচালনাকারী জনাব এস এম সাহেবের নামে কোন মামলা হয় নি। এই থেকে পরিষ্কার ভাবেই প্রমাণ হয় ট্রাস্টের এই টাকাগুলো কারও ব্যক্তিগত অধীনে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়াটা আইনগত প্রশ্নের উর্ধ্বে। তাই যারা শুরুতে এজাহারটি পড়ে ট্রাস্টের টাকাগুলো ব্যক্তিগত FDR তৈরি করা নিয়ে আইনগত বৈধতার সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তাদের এই প্রশ্নগুলো প্রশমিত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!
এবার ফিরে যাই ২য় ও ৩য় FDR এর টাকার সন্ধানে। যে গুলো প্রত্যেকটি ছিল ১ কোটি টাকা হিসেবে মোট দুই কোটি টাকার পৃথক দুইটি FDR । আপনারা সবাই এতক্ষনে এজাহার পড়েই এই টাকার গন্তব্য জেনেছেন! এই গুলো এক সময় সলিমুল হক, সৈয়দ আহমেদের নামে ব্যক্তিগত FDR ছিল। পরবর্তিতে এই টাকার একটি FDR গিয়াসউদ্দিনের নামে ৭/০২/২০০৭ তারিখে ১ কোটি ৩ লক্ষ ১৯ হাজার ৩৬৫ টাকা নগদায়ন হয়। একই তারিখে ১ কোটি ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ৯ শত ৫৭ টাকা আরেকটি FDR নগদায়ন হয়। অর্থাৎ গিয়াসউদ্দিন সাহেবের নামে সর্বমোট ২ কোটি ১০ লক্ষ ৭১ হাজার ৬ শত ৪৩ টাকা ব্যক্তিগত FDR হিসেবে ট্রাস্টের টাকা পরিচালনার জন্য জমা হয়।
পরবর্তী সপ্তাহখানেক পর গিয়াসউদ্দিন সাহেব ১৫ /০২/২০০৭ তারিখে আলাদা আলাদা ৬ টি পে অর্ডারের মাধ্যমে সবগুলো টাকাই উত্তোলন করেন। টাকাগুলো উত্তোলনের ঠিক ২০ দিন পর ৭ ই মার্চ ২০০৭ সালে ট্রাস্টের সেটেলর জনাব তারেক রহমানকে ১/১১ সরকার গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ২৮/০৩/২০০৭ সালে গিয়াসউদ্দিন সাহেব কর্তৃক উত্তোলিত সমস্ত টাকাই শরফুদ্দিন নামে এক ব্যক্তির চলতি হিসাবে জমা হয়।
এই পর্যায়ে শরফুদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত চলতি হিসাবে টাকাগুলো জমা হওয়ার কারন অনুসন্ধান করা যাক।
জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের টাকাগুলো এতিমদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য ট্রাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিগণ আশুলিয়ায় জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্টের নামে ৭৬ শতাংশ জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেন।সেই কারনে গিয়াসউদ্দিন সাহেব কর্তৃক উত্তোলিত টাকাগুলো জমির মালিক শরফুদ্দিনের ব্যক্তিগত চলতি হিসাব এ জমির দাম বায়না স্বরুপ পুরো টাকাটাই জমা করে দেন।কথা ছিল, জমির মালিক তার জমি উন্নয়ন করে দেওয়ার পর জমিটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে রেজিস্ট্রি করা হবে।
তারেক রহমান জেলে থাকায় সেই জমিটি বায়নার পর আর রেজিস্ট্রেশন সংগত কারনেই সম্ভব হয় নি।ট্রাস্টের কর্তৃপক্ষের এই ব্যর্থতায় জমির মালিক বায়নার টাকাগুলো পুরোটাই সুদে আসলে ট্রাস্টে ফিরিয়ে দেন।
জনাব তারেক রহমান জেল থেকে ছাড়া পান ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখ এবং চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যান ১১ ই সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখ। মুক্তি পাওয়ার আগেই ১/১১ সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন ৩রা জুলাই ২০০৭ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ১নং আসামী এবং তারেক তারেক রহমানকে ২নং আসামী করে মামলা দায়ের করে।
পরিশেষে
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে শুধুমাত্র বগুড়া জেলার গাবতলী থানাধীন দাড়াইল মৌজায় সেই ১৯৯৩ সালে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ২ দশমিক ৭৯ একর জমি ক্রয় ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে একটি পয়সাও ব্যয় হয়নি। উপরন্তু সকল টাকা ট্রাস্টের অধীনে ব্যাংকেই আছে, যা সুদে আসলে আজ ৬ কোটি টাকার অধিক হয়েছে। যেখানে টাকা ব্যয়ই হয়নি, সেখানে টাকা আত্মসাতের প্রশ্ন আসে কিভাবে?