মুসাফির রাফি
সাম্প্রতিক সময়ে সাধারন ছাত্রদের উপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলা এবং ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে কলহ, অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অঘোষিতভাবে ছুটি দিয়ে দেয়া হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, ফলে সার্বিকভাবে পড়াশুনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
আগামী মার্চে ছাত্রলীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার কথা আছে। তাকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা দেখানোর প্রতিযোগিতা। দল যেহেতু ক্ষমতায়, তাই হালুয়া রুটি খাওয়ার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেনা কেউই। ছাত্রলীগের এই সম্মেলন গত বছরের জুলাইতে হওয়ার কথা থাকলেও এই সব আভ্যন্তরীন সংঘাত আর সংঘর্ষের কারনেই নির্ধারিত সময়ে তা সম্পন্ন করা যায়নি।
নিজেদের মধ্যে কলহ, অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটা সংঘর্ষে গত জুলাই থেকে এই পর্যন্ত ৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছে। আর গেল সপ্তাহে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ৭টি সরকারী কলেজকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় সাধারন ছাত্রদের উপর ছাত্রলীগ ক্যাডারদের ন্যাক্কারজনক ঘটনায় সারা দেশে ছাত্রলীগের ভাবমুর্তি আরেকবার ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
- ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে এই মুহুর্তে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে আছে পাবনা এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ।
- গত জুলাই থেকে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও। এই মাসের শুরুতে ছাত্রলীগের ডাকা হরতালের কারনে সিলেট সরকারী কলেজ এবং এমসি কলেজে কোন ক্লাস হয়নি।
- জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ১৫জন ছাত্রকে বহিস্কার করে তার মধ্যে দুজনই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ সম্প্রতি টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন ঘটনা ঘটেনি’ দাবী করে বেশ হাসির পাত্রে পরিনত হয়েছেন। তেমনি আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন কোন্দলের কথাও অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, মিডিয়ায় যা আসছে, তা মোটেও ঠিক নেই। ছাত্রলীগের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। তাই এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে কোন সহিংসতা ঘটার প্রশ্নই আসেনা।’
ছাত্রলীগের সভাপতি যাই বলুক না কেন, বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নেই। গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারন ছাত্রছাত্রীরা ভিসির কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের দাবী, ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বেশ কিছু ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছে- তাদের বিরুদ্ধে যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করে।
সাধারন ছাত্ররা সেদিন ভিসির সামনে ছাত্রলীগের নোংরামির বিরুদ্ধে চরম উত্তেজনা প্রদর্শন করে। তারা অভিযোগ করে যে, ছাত্রলীগ নেতারা বিক্ষোভরত মেয়েদেরকে নোংরা ভাষায় গালি গালাজ করেছে, অশ্নীল ইংগিত করেছে এবং অপমান করে মেয়েদের মুখে বাদামের খোসাও ছুড়ে মেরেছে।
ভিসি আখতারুজ্জামান অবশ্য সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতার সময় ছাত্রলীগের এইসব ক্যাডারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নিশ্চয়তা দেন। যদিও তিনি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭টি সরকারী কলেজকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে দাবী করেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি তার পুরনো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এইসব অভিযোগকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তার সংগঠনের নেতাকর্মীরা মেয়েদেরকে খুবই সম্মান করে তাই মেয়েদের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে অশ্নীল আচরন করার কোন প্রশ্নই আসেনা।
এরই মাঝে বিগত কয়েকদিনের মধ্যে ছাত্রলীগ আরো কিছু অপকর্ম সম্পাদন করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ৭ ডিসেম্বর ২০১৭, মৌলভীবাজারে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার সংঘর্ষে নিহত হয় সিলেট সরকারী কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খান।
- ১৬ অক্টোবর ২০১৭, একই রকম আভ্যন্তরীন সংঘাতের জেরে নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী এবং সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র ওমার আলী মিয়াদ।
- সিলেটে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জুলাই মাসের ১৭ তারিখে ছাত্রলীগ কর্মী খালেদ আহমেদ লিটু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
- ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে ছাত্রলীগের সংঘাতের কারনে বন্ধ করে দেয়া হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সংঘাতের ঘটনায় আহত হয় ১০ জন ছাত্র। একটি সাধারন ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে সংঘাতের সুত্রপাত হয়। এর আগে গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়ারে বসে দেশব্যপী সমালোচনার শিকার হন।
- ছাত্রলীগের সংঘাতের জের ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ৪ জানুয়ারী। একই দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সম্মেলনে সংঘর্ষে দুজন ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়।
- ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ১০ জন ছাত্র আহত হওয়ার প্রেক্ষিতে পাবনা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ১২ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
- ৮ জানুয়ারী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আফসানা আহমেদকে তার হলের রুম থেকে নীচে ফেলে দেয় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। আফসানার অপরাধ ছিল সে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সম্মেলনে যোগ দেয়নি।
- ১৭ জানুয়ারী, ২০১৮ তারিখ বুধবার, স্কুল ছাত্র আদনান ইসফারকে উপুর্যপরী ছুুরিকাঘাত করে হত্যা করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত যতজনকে এই পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সকলেই প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট।
- ১৬ জানুয়ারী মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত মেয়র প্রাথী সেলিমউদ্দিনকে নিয়ে দেয়া পোস্টে লাইক দেয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্য বিভাগের ছাত্র মুহাম্মাদ মুরাদকে রাতভর নির্যাতন করে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছয় ঘন্টা পর রাত সাড়ে ৪ টায় রক্তাক্ত অবস্থায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাড়ির সদস্যরা মুরাদকে উদ্ধার করে।
এই হলো ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের সাম্প্রতিক সময়ের অপকর্মের কিছু চিত্র। দ্রব্যমূল্য, অসহনীয় নাগরিক সংকট এবং মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি করে জনগনের কাছে আওয়ামী লীগ এমনিতেই আছে ইমেজ সংকটে। তার উপর আবার এই বল্গাহীন ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ এখন সত্যিই সরকারের জন্য গোদের উপর বিষফোড়া।