অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
তিন দিনের সফর শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকা ছেড়েছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখার্জি। প্রণব বাবু চলে গেলেও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে তোলা একটি ছবি নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ছবিতে চেয়ারে বসা প্রণব বাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদের স্পিকার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
ভারতীয় হাইকমিশনের সাইটে ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পরই এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশিষ্টজনেরাসহ সাধারণ মানুষও কঠোর সমালোচনা করছেন। ভারতের করুণায় আগামীতে আবার ক্ষমতায় আসতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিজেদের এবং দেশের আত্মসম্মান, মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছেন বলেও মনে করছেন তারা। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, ক্ষমতার জন্য রাজনীতিবিদরা এত নীচে নামতে পারেন?
অবশেষে কঠোর সমালোচনার মুখে শুক্রবার ভারতীয় হাই কমিশন সেই ছবিটিসহ আরো কতগুলো ছবি তাদের সাইট থেকে সরিয়ে ফেলেছে। ছবি সরালেও দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় এখনও বইছে।
এদিকে ছবি নিয়ে সমালোচনা হলেও রাজনীতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর চেয়ে বড় বিষয় হলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রণব বাবুর দেয়া বক্তব্য। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে প্রণব বাবুর এই সফর অনেক কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, অভিযোগ আছে প্রণব বাবুর নির্দেশেই আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করতে সাহস পেয়েছিল। তাই হঠাৎ প্রণব বাবুর নিয়ে রাজনীতিক বিশ্লেষকরাও চুলছেড়া বিশ্লেষণ করছেন।
বুধবার চট্টগ্রামে গিয়ে প্রণব মুখার্জি বলেছেন, একটি দেশে দীর্ঘ দিন সেনা শাসন থাকলে সেই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পিছিয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র। আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রণব মুখার্জির দেয়া এ বক্তব্য তার বাস্তব কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি এখন উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের কথা বললেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংসের মূল কারিগর হলেন তিনি নিজেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ প্রণব মুখার্জির ইন্ধনেই করেছিল। পিলখানার নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সবই আওয়ামী লীগ করেছে প্রণব মুখার্জির সমর্থন পেয়েই। প্রণব মুখার্জি ও তার দল কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এমনকি প্রণব মুখার্জিকে শেখ হাসিনা নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবেই মনে করেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিই দেশটির পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। সুজাতা সিং এসেই আওয়ামী লীগকে বলেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটকে বাদ দিয়েই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। ভারত থেকে এই আশ্বাস পেয়েই শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করে। আর এসবের পেছন থেকে মূল নায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। আর ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধসে পড়ে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এসে সেই প্রণব মুখার্জির মুখে গণতন্ত্রের বাণী শুনে রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ অবাক হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশেতো বর্তমানে গণতন্ত্রের ‘গ’ও নেই। বিরোধীদলতো দূরের কথা সাধারণ মানুষও সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারছে না। আর আগামীতেও সরকার বিরোধীদলকে বাদ দিয়েই আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করার চেষ্টা করছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে যখন দেশের প্রধান দুই দল দুই মেরুতে অবস্থান করছে ঠিক এই সময়ে প্রণব বাবুর সফর খুব তাৎপর্য বহন করে। প্রণব বাবুর বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে আবারো তিনি আওয়ামী লীগকে দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচন করাতে চাচ্ছেন।
এছাড়া ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল প্রণব বাবুর হস্তক্ষেপেই। যেটা প্রণব বাবুর নিজের হাতে লেখা বই থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে। তিনিই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনকে বাধ্য করেছিলেন।
‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইতে প্রণব বাবু লিখেছেন, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি। তখন বাংলাদেশে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। তিনি ছয় দিনের ভারত সফরে এলেন। আমার সাথেও সাক্ষাৎ করলেন তিনি। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়ার গুরুত্ব তুলে ধরলাম। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাকে বরখাস্ত করতে পারেন শেখ হাসিনা, এ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিলাম। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ওই জেনারেলকে পদে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দিলাম। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলাম। উদ্দেশ্য, তাকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য অনুরোধ করা, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তি নিশ্চিত করা। আমি তখনকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি নিশ্চিত করলাম এবং দেশটিকে স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনলাম। বেশ কয়েক বছর পর জেনারেল মইনের যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার পথ সহজ করে দিই, তখন তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
তিনি আরও লিখেছেন, শেখ হাসিনা (আমার) ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। যখন আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলাম, তখন ভারত তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে তত্ত্ববাবধায়ক সরকারের ওপর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে। যখন তিনি জেলে ছিলেন এবং তাকে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা ত্যাগ করেছিলেন, আমি তাদেরকে তাদের অবস্থানে ফিরে যেতে তাগিদ দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, তারা এমন একজনকে ত্যাগ করছেন, এটা অনৈতিক। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হলেন শেখ হাসিনা।
প্রণব বাবুর এই লেখাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি কীভাবে হস্তক্ষেপ করছেন।