আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদক নিয়ন্ত্রণ। এ দুই কারণে সমাজের বড় অংশের মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া না গেলেও পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও বিক্রিতে সহযোগিতা করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে হরহামেশা। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬৭ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
মাদক নির্মূলের লক্ষ্যে গত ৩১ জানুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সারা দেশের পুলিশের জন্য ১০ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। প্রথম দফায় বলা হয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদক বিক্রেতার কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, তাঁদের চিহ্নিত করে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা, প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপর জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ মাসের শেষে বাকি ছয় মাসের মোট হিসাব পাওয়া যাবে।
মাদকবিরোধী অভিযান নজরদারির দায়িত্বে আছেন, এমন একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদক কোথায়, কীভাবে, কারা বিক্রি করছে, তা মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নখদর্পণে। একশ্রেণির পুলিশ সদস্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে মাদক বিক্রির সুযোগ করে দেন, এ অভিযোগ অসত্য নয়।
ঢাকার মাদক বিক্রির জন্য পরিচিত তিনটি স্থান ঘুরে, সেখানকার স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ বক্তব্যের সত্যতা পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। মাদক বিক্রেতারা বলছেন, পুলিশ সদস্যদের একটা অংশ মাদকের সঙ্গে তিনভাবে জড়িত। কেউ কেউ মাদক গ্রহণ করছেন, কেউ কেউ সোর্সের মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া মাদকদ্রব্যের একটা অংশ আবার বিক্রি করে দিচ্ছেন, কেউ ঘুষ নিয়ে মাদক বিক্রিতে সহযোগিতা করছেন। কেউ কেউ সরাসরি নিজেরাই মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়েছেন, এমন অভিযোগে একাধিক পুলিশ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ ছাড়া মানুষকে হয়রানি করার জন্য পকেটে ইয়াবা (এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রীত মাদক) গুঁজে দিয়ে মামলা দিচ্ছে বা মামলার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ আছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র উপমহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) আবদুল আলিম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের ব্যাপারে পুলিশের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্ট’ (কোনো ছাড় নয়)। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও অবস্থান একই রকম। পুলিশের বাইরে কেউ মাদক গ্রহণ বা বিক্রি করলে একটি মামলা হয়, কিন্তু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি বিভাগীয় মামলাও হচ্ছে।
অভিযুক্তদের বড় অংশ ঢাকার
মাদকে জড়িত থাকার অভিযোগ যে ৬৭ জন পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ঢাকা মহানগরের গুলশান, ওয়ারী, মতিঝিল ও তেজগাঁও অঞ্চল, পুলিশের কল্যাণ ট্রাস্ট, পরিবহন শাখা ও দাঙ্গা দমন বিভাগের (পিওএম) ২৩ জন, যশোরের ১০ জন, টাঙ্গাইলের ৭ জন, বগুড়ার ৪ জন, নোয়াখালীর ৩ জন, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও হাইওয়ে পুলিশের ২ জন করে, খাগড়াছড়ি, সিলেট, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ, বরিশাল, সিলেট পুলিশের ১ জন করে এবং র্যাবের ৩ জন সদস্য আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিভাগীয় শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মাদক গ্রহণের দায়ে পাঁচজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের তিনজনই নোয়াখালী জেলার। বাকি দুজন খাগড়াছড়ি ও হবিগঞ্জের।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াস শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী উপপরিদর্শক শিমুল কান্তি দাশ, কনস্টেবল শাহীন আহম্মেদ ও কনস্টেবল মো. শাহনেওয়াজ রাসেলের বিরুদ্ধে বারবার মাদক গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাঁদের শরীরে মাদকের উপস্থিতি পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মধ্যে ওয়ারী ডিভিশনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে। ওয়ারী ডিভিশনের উপকমিশনার মো. ফরিদউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি ফেনসিডিলে আসক্ত এক পুলিশ সদস্যকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে নিয়মিত মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাছে ৪৩ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়। এর বাইরে ওয়ারীতে মাদকসহ পর্যটন পুলিশের এক সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনায় মামলা চলছে এখন।
সরেজমিন মাদকের আখড়া
মিরপুরে মাদক বিক্রির একটা আখড়া রয়েছে চলন্তিকা এলাকায়। পুলিশের দাবি, তারা কয়েক দিন আগেও সেখানকার মাদক বিক্রেতাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গত বুধবার চলন্তিকা বস্তিতে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
বস্তিতে ঢোকার মুখে বেশ কটি চায়ের দোকান আছে। এ এলাকায় কারা মাদক বিক্রেতা, পুলিশের ভূমিকা কী—এমন প্রশ্নে একজন দোকানদারও মুখ খুলতে রাজি হননি। এ সময় সেখানে উপস্থিত তৈরি পোশাক কারখানার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযান চালায় এটা যেমন সত্য, ইয়াবা বিক্রি হয় এটাও সত্য। পুলিশকে হাতে রেখেই মাদকের কারবার চলছে। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে চা দোকানিরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা জানাজানি হলে তাঁদের বিপদ হবে। পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। এ কারণে কেউ কথা বলছে না।
বস্তির শেষ মাথায় পৌঁছে এক বৃদ্ধ ও তিন যুবককে একটি ছাপরা ঘরের বাইরে বসে থাকতে দেখা যায়। ওই ঘর থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হচ্ছিল। কিসের গন্ধ এটা, জানতে চাইলে কাছে বসে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ওই ঘরে ‘বাবা’ বিক্রি হয়।
জানা গেল, মাদক বিক্রেতারা ইয়াবাকে বাবা বলে। ওই ব্যক্তি জানালেন, পুলিশ সবই জানে। মাঝেমধ্যে কাউকে কাউকে ধরেও নিয়ে যায়।
পুলিশি অভিযানের পরও কীভাবে মাদক বিক্রি চলছে, এ নিয়ে কথা হয় একজন মাদক বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অবৈধ ব্যবসা সব সময় পুলিশকে জানিয়ে করতে হয়। ধরেন, আমরা মোবাইলে কাস্টমারকে খবর দিই। কাস্টমার নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে জিনিস নিয়ে যায়। ওই জায়গাটা যারা কিনবে তারাও চেনে, পুলিশও চেনে।’ পুলিশ চিনলে কীভাবে এটা করেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশের ইনফরমারের (আসলে ঘুষের দালাল) মাধ্যমে টাকার পরিমাণ ঠিক হয়। প্রতি সপ্তাহে ইনফরমার এসে তা নিয়ে যায়। মাদকবিরোধী অভিযানের আগে দারোগারা খবরটা জানিয়ে দেন। তখন তাঁরা সরে পড়েন।’ তিনি সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা করে পুলিশকে দিতেন বলেও জানান।
একই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে খিলগাঁও ও শেরেবাংলা নগর এলাকায় ঘুরে। স্থানীয় লোকজন জানেন কোথায় কোথায় মাদক বিক্রি হয়। খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার দুজন বাসিন্দা বলেন, মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক আছে। কখনো কেউ যদি ধরাও পড়েন, কিছুদিন পর বেরিয়ে এসে আবার একই মাদক বিক্রিতে যুক্ত হন। শেরেবাংলা নগর এলাকার বাসিন্দা একজন সিএনজি অটোরিকশার চালক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকায় পুলিশের ‘ইনফরমার’দের সঙ্গে ঘুষের হার ঠিক করার ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের মাস্তানরা মধ্যস্থতা করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিট পুলিশিং বা ওপেন হাউস ডের দিন আমরা সবাই মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলি। মাদকবিরোধী সভাও হয়। তারপর সব ভুইলা যাই। জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ দুই পক্ষই সুযোগ-সুবিধা পায় ও চুপ কইরা থাকে।’ ওই কাউন্সিলর বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা আসার পর সাধারণ মানুষের হয়রানিও বেড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলেন, তাঁর এলাকার বিপণিবিতানের এক কর্মচারী রাত করে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ নিরাপত্তাতল্লাশি করার নামে তাঁর পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মামলা দেয়। ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেলেও নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে এখনো।
গত ২৫ অক্টোবর কক্সবাজারের টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের পর কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ছয় সদস্যকে সেনাসদস্যরা গ্রেপ্তার করেন। অপহৃত ব্যবসায়ী আবদুল গফুরকে উঠিয়ে নিয়ে ডিবির সদস্যরা ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। টাকা দিতে না পারলে তাঁরা ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের বলেন, কোন ব্যবসায়ী সচ্ছল সে সম্পর্কে পুলিশের ইনফরমাররা খবর পৌঁছায়। তারপরই চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটে থাকে।
সম্প্রতি রাজশাহী জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় গোদাগাড়ী পৌরসভার মেয়র ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মনিরুল ইসলাম গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ওসি ‘গডফাদার’ দিয়ে ব্যবসা করাচ্ছেন আর সাধারণ মানুষ বা যাঁরা মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, তাঁদের বাড়িতে গভীর রাতে তল্লাশির নামে হয়রানি করছেন।
এর আগেও সিআইডির অনুসন্ধানে মাদক ব্যবসায় পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফেনীতে র্যাবের হাতে প্রায় সাত লাখ ইয়াবাসহ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাহফুজুর রহমান গ্রেপ্তার হন ২০১৫ সালের ২০ জুন। পুলিশ জানতে পারে, ওই ঘটনায় জড়িত আছেন ১০ জন পুলিশ সদস্য। মাহফুজুর রহমানের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত ১৬ নভেম্বর ঢাকা থেকে এসবির এএসআই শাহীন মিয়াকে সিআইডি গ্রেপ্তার করে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, কোথা থেকে মাদক আসছে, কোথায় কীভাবে বিক্রি হচ্ছে তা পুলিশের জানা। কাজেই এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা পুলিশের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। আর পুলিশ সদস্যরা যেন জড়িয়ে না পড়েন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে পুলিশের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই চাকরিচ্যুত করেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ। মাদক তরুণদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে হবে না। রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে যে মাদক একটা সমস্যা। অপরাধী যে-ই হোক শাস্তি হবে, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। মাদক নির্মূলের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হওয়া চাই।’
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post