অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে পাশ্ববর্তি দেশ ভারতের ভূমিকা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। এদেশের রাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানেন। একটা ধারণা প্রচলিত আছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একতরফা সে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার টিকে আছে বলে মনে করেন অনেকেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সমর্থন দেয়ায় গত আট বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এছাড়া এটি খুব স্পষ্ট যে ভারতে যে দলই ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা সবসময় আওয়ামী লীগকেই সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুরাও সবসময় আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের এই সম্পর্ক যত ঘনিষ্টই হোক না কেন, মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলতেও দেখা গেছে। তাই বলে এমন নয় যে, তারা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে যা ঘটেছে তার একটি পক্ষ হিসেবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’কেও মনে করা হয়। মনে করা হয় ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বিষয়ক রায়ে প্রধান বিচারপতির নজিরবিহীন পর্যবেক্ষনটি তাদের হাত ধরেই এসেছে।
বিবিসির সাবেক ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক কর্তৃক মিয়ানমার ও ভারতের দুটি সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথিত হত্যাচেষ্টার খবর প্রকাশও একই যায়গা থেকে হয়েছে বলেই মনে করা হয়। এই সুবীর ভৌমিক ‘র’ এর খুবই ঘনিষ্টজন বলেই সর্বজনবিধিত।
বাংলাদেশের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান সিজার সম্প্রতি গুম হয়েছেন। দু’দিন আগে তার গুমের জন্য ভারতের দ্যা ওয়্যার নামে একটি পত্রিকা সরাসরি বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে দায়ী করেছে। তারা সরাসরি বলেছে সিজারকে ডিজিএফআই গুম করেছে। এই সংবাদের পরদিনই বাংলাদেশে সেই ওয়েবসাইটটি ব্লক করে দিয়েছে বিটিআরসি।
এদিকে ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বাংলাদেশে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করছে’ এমন শিরোনামে আজ শনিবার নিউজ করেছে ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানায়, ‘শুধু রংপুরেই নয়, আওয়ামী লীগের নেতারা কক্সবাজারে বৌদ্ধমন্দিরে হামলার সঙ্গেও যুক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু এলাকায় হামলার জন্যও তারা দায়ী। যেসব নেতা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করেন, তাদের ভূমি কেড়ে নেন তাদেরকে আর ভোট দেবে না হিন্দুরা। কারণ, আমরা নির্যাতিত হই, কোনো রাজননৈতিক নেতা বা পুলিশকে আমাদের পাশে পাই না।’
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের মধ্যে যে ঘনিষ্ট সম্পর্কের চাউর রয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক উপরের ঘটনাগুলো। কারন আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলে এমন নিউজ ভারতীয় পত্রিকা আসার কথা ছিলো না। কেননা ভারত আওয়ামী লীগে পরীক্ষিত বন্ধু। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তারা সেটার প্রমান দিয়েছে। এমনটি ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে সম্পর্কে বর্ণিত কিছু ঘটনা থেকেও সেটার প্রমান পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন হলো ভারতীয় পত্রিকায় এমন নিউজ ও ‘র’ এর রহস্যময় আচরণের কারণ কি? এ থেকে কি বুঝা যায় দুই পক্ষের মধ্যে কিছু নিয়ে টানাপোড়েন চলছে? যেটার ফলস্রুতিতে এই স্নায়ুযুদ্ধ?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সরকারকে ভারত তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতেই মাঝে মাঝে এমন নড়াচড়া দিচ্ছেন। এটা হাসিনার প্রতি এক প্রকাশ থ্রেড হিসেবেও মনে করেন তারা। শেখ হাসিনা যেনা ভারতের স্বার্থ রক্ষার ধারাবাহিক কার্যক্রম থেকে সরে না যান তার জন্যই এসব পরোক্ষ থ্রেড বলেও মনে করছেন তারা।
তবে অনেকে মনে করছেন, ভারত একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদি দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সবসময়ই তারা সোচ্চার ছিলো। যদিও নিজে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান নির্যাতনের বেলায় তারা পুরোই বিপরীত অবস্থানে আছেন। নামে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ভারতে সংখ্যালঘু ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত। যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা দু একটিও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ ভারতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কট্টর গোরক্ষকদের হাতে মুসলমানরা নির্যাতিত ও হত্যার শিকার হচ্ছেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যাপারটিকেও অনেকে ভারতের হিন্দুস্বার্থ রক্ষার সাথে মেলালেও প্রধানমন্ত্রীকে কথিত হত্যাচেষ্টা, মোবাশ্বার হাসান সিজার গুম হওয়া, ভারতীয় সাইট বন্ধ করে দেয়াসহ অন্যান্য ব্যাপারগুলোকে বিশ্লেষকরা দুইপক্ষের স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবেই দেখছেন। ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে বেশিদিন অবস্থান করতে না দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি যেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর কণ্যা কি পারবেন সেই সার্বভৌমত্বকে ধরে রাখতে? ভারতের স্নায়ুযুদ্ধ কিংবা পরোক্ষ থ্রেড শেখ মুজিবকে থামাতে পারেনি, ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনা কি তার পিতার বিপরীতে হাঁটবেন?
Discussion about this post