মুহাম্মদ নোমান
[বলকান। পূর্ব ইউরোপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আমাদের কাছে এই অঞ্চলের আবেদন ইউরোপের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশী। কারণ, এই এলাকাটি হচ্ছে আমাদের জন্য ইউরোপের প্রবেশদ্বার। উসমানীরা দীর্ঘ ৪০০ বছর এই এলাকা শাসন করেছে। এথেন্স থেকে নিয়ে বেলগ্রেড হয়ে ভিয়েনার দোরগোড়া পর্যন্ত তারা ইসলামের হেলালী নিশান বয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ফ্রান্স এবং জার্মান রাজ্যগুলো এক সময় তাদেরকে কর দিতে বাধ্য হতো। কিন্তু এখন উসমানী সালতানাত নেই। কিন্তু উসমানীদের শৌর্যবীর্যের সাক্ষী হয়ে বলকানের বুকে এখনও দাঁড়িয়ে আছে ৩ টি মুসলিম রাষ্ট্র- বসনিয়া, আলবেনিয়া এবং কসোভো। স্বাভাবিকভাবেই অনাগত দিনগুলোতেও এই এলাকার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক জড়িত থাকবে। এটাও স্বাভাবিক যে, বলকান রাষ্ট্রগুলো তুরস্কের দিকে যুগপৎ ভয় ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দখবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে খেলাফাতে উসমানীয়ার বিলুপ্তির পর থেকে নিয়ে ৮০ র দশক পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৬০/৭০ বছরে দুই পক্ষের শত্রুতা কিছুটা কমলেও, বসনিয়া এবং কসোভো-যুদ্ধ দুই পক্ষের উত্তেজনাকে আবারও চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই তুর্কি-বলকান সম্পর্ককে সবসময় সাপে-নেউলে সম্পর্ক মনে করতাম। কিন্তু গত ১০ ই অক্টোবর ২০১৭ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের সার্বিয়া সফর এবং ১৭ ই অক্টোবর পোল্যান্ড সফরের চিত্র দেখে আমি খুব অবাক হই। কারণ, বেলগ্রেড এরদোগানকে যে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়েছে তা অকল্পনীয়। এরদোগানের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন- “আমি আমার গোটা মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে মধ্য রাত পর্যন্ত তুর্কি প্রেসিডেন্টের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করেছি”। ঐতিহ্যগতভাবে তুরস্কের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বলকান রাষ্ট্রের এমন নাটকীয় পরিবর্তন বেশ নজর কাড়ার মতো। এর রহস্য খুজতেছিলাম। খুঁজতে গিয়ে এ বিষয়ে Vuk Vuksanovicএর একটি লেখা পেলাম। লেখাটি তিনি এরদোগানের সার্বিয়া সফরকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। লেখক বর্তমানে the London School of Economics এ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর পিএইচডি করছেন। পূর্বে সার্বিয়ার ফরেন মিনিস্ট্রিতে উপদেষ্টা হসেবে কর্মরত ছিলেন। বিখ্যাত আমেরিকান ম্যাগাজিন The National Interest এর ১৭ ই অক্টোবর সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি এখানে ভাষান্তর করার চেষ্টা করেছি। ]
গত ১০ ই অক্টোবর ২০১৭ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এক রাষ্ট্রীয় সফরে সার্বিয়া আসেন। সেখানে তিনি সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট Aleksandar Vučić এর সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন। এরদোগান সেখানে বলেন- “সার্বিয়া এবং অন্যান্য বলকান রাষ্ট্রের সাথে মিলে আমরা সব সমস্যার সমাধান বের করবো”। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টও এরদগানের কথাকে সমর্থন করে বলেন- “সার্বিয়া তুরস্ককে এখন তার বন্ধু মনে করে”। প্রকৃতপক্ষে, এরদোগানের এই সফরটি ছিল দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর। এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, এখন তুরস্ক বলকান অঞ্চলের “মেজর প্লেয়ার”এ পরিণত হয়েছে। তুরস্কের সাথে বর্তমানে বেশ কিছু রাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সেই তুলনায় বলকানকে তুরস্কের সফল পররাষ্ট্রনীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যায়।
এই অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্যের দীর্ঘ উপস্থিতির সুবাদে দুই পক্ষের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টি হয়তো বা আশ্চর্যের কিছু নয়, কিন্তু তুরস্কের বিগত একশো বছরের পররাষ্ট্রনীতির দিকে তাকালে এটিকে একটি নতুন সূচনা হিসেবে ধরে নিতে হয়। কারণ, বলকান যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তার পরিপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটার কারণে এই এলাকার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ, তখন আতাতুর্কের নতুন তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে বলকানের স্ট্র্যাটেজিক কোন গুরুত্ব ছিল না। এছাড়াও, তখন তুরস্কের ডিপ্লোম্যাসি “ঘরে শান্তি তো দুনিয়ায় শান্তি”- আতাতুর্কের এই নীতিতে বন্দি ছিল। এই শ্লোগানের আড়ালে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। যে এলাকাগুলো ঐতিহ্যগতভাবে অটোমানদের প্রভাবাধীন ছিল সেগুলোতে প্রভাব ধরে রাখার কোন প্রচেষ্টাই নতুন তুরস্কের মধ্যে দেখা যায় নি। দেশটির এই নীতি শীতল-যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক বলতে কেবল বাহ্যিক কূটনৈতিক সম্পর্কই অব্যাহত ছিল। আঙ্কারা তখন এই এলাকার দিকে যে যৎসামান্য গুরুত্ব দিতো তাও ছিল সোভিয়েত-হুমকি মোকাবেলা করার জন্য। সে সময়কার আঙ্কারা-বলকানের সম্পর্কের একটি উদাহরণ হচ্ছে পঞ্চাশের দশকে তুরস্ক, গ্রীস এবং যুগোস্লাভিয়াকে নিয়ে বলকান চুক্তির একটি প্রচেষ্টা, যা ব্যর্থ হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, মধ্য-এশিয়ায় তুর্কি ভাষাভাষী বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, পাশাপাশি যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গন এবং ভাঙ্গন-পরবর্তী সময়ে দেশটির বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া- এসব কারণ তুরস্ককে আবারও ইউরেশিয়ায় আঞ্চলিক পরাশক্তিরুপে ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি সর্বশেষ বলকান যুদ্ধগুলোতে বসনিয়া, আলবেনিয়া এবং কসভোকে তুরস্কের জোরালো সহযোগিতা বলকান রাষ্ট্রগুলোকে – বিশেষ করে বেলগ্রেড এবং এথেন্সকে – এই উদীয়মান শক্তির ব্যপারে ভয় ধরিয়ে দেয়। ৯০ এর দশকে তুরস্ককে নিয়ে ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল Islamic Arc (ইসলামী চাপ) বা the green transversal (সবুজ লাইন)। উদ্দেশ্য হচ্ছে- বলকানের সেসব জায়গা যেখানে মুসলমানরা বসবাস করে। এগুলো তুরস্ক থেকে নিয়ে বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়ার সাঞ্জাক এলাকা, কসভো এবং বসনিয়া হার্জেগোভিনা পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব এলাকার প্রতি তুরস্কের সহযোগিতাকে অনেকে গ্রীসকে বলাকন থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং এথেন্স ও বেলগ্রেডের মাঝে পথরোধ করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখত। হয়তো এখন এটা ভুলা সহজ যে, ৯০ এর দশকে আমেরিকার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে – যেমন হেনরি কিসিঞ্জার এবং নিউকনজারভেটিভ নেতা যোশোয়া মুরাভিশক – এই ভয় ছিল যে, বসনিয়া যুদ্ধ কসভো এবং মেসিডোনিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়বে এবং এর সুত্র ধরে তুরস্ক এবং গ্রীস সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
আহমেত দেভুতুলুর যুগে এসে তুরস্কের বলকান বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি অনেক বেশী গুছিয়ে উঠে এবং বাস্তববাদী হয়ে উঠে, যিনি একজন পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট হওয়ার পাশাপাশি ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি একটি গ্রন্থও লিখেন Strategic Depth: Turkey’s International Position নামে যার এখনও ইংরেজি অনুবাদ হয়নি। দেভুতুলু তাঁর এই গ্রন্থে এ বিষয়ের উপর জোর দেন যে, তুরস্ককে অবশ্যই ইউরেশিয়া অঞ্চলে আবারও মেজর পাওয়ার হিসেবে ফিরে আসতে হবে এবং এটা সম্ভব হবে সক্রিয় ও শক্তিশালী ফরেন পলিসির মাধ্যমে অটোমান শাসনাধীনে থাকা এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বলকান এলাকা। তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি যে রকম শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে, সেই তুলানায় দেশটির বলকান নীতি তার আন্তর্জাতিক মনোযোগের বিষয় কখনোই হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে দেভুতুলু বলকানের উপর যে গুরুত্বারোপ করেছেন সে ব্যাপারে পশ্চিমের অনেকেই বেখবর ছিল। তিনি তাঁর গ্রন্থে বলকান যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে লেখেন যে, এগুলো সেইসব এলাকা যেখান থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছিল। এবং এখনও বলকানে তুরস্কের শক্তিশালী অবস্থান দেশটিকে একটি শক্তিশালী ইউরোপিয়ান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বলকানে প্রভাব বিস্তার এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহ্য গড়া ছাড়া তুরস্কের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরেশিয়ায় কার্যকর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না। এই জন্য তুরস্ককে বলকান দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে এবং এ অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীদেরকে শক্তিশালী করতে হবে।
২০০৮ সালের দুনিয়াব্যাপি অর্থনৈতিক সংকট তুরস্কের জন্য বেশ বড় সুযোগ নিয়ে আসে। আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো তাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঐ সংকটের কারণে তুরস্ক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ফলে, দেশটি তার ডিপ্লোম্যাসি এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে। বলকানে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা এবং ঐ অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আঙ্কারা খুবই সিরিয়াস ছিল। কিন্তু তুরস্কের নেতাদের অতিউৎসাহী ও অতিআত্মবিশ্বাসী কিছু বক্তব্য তখন বেলগ্রেডকে ক্ষুদ্ধ করে। বলকানের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো, যেমন বুলগেরিয়া, তুরস্কের প্রতি বিদ্বেষত্বক নীতি প্রদর্শন করে। ২০১৩ সালে এরদোগানের কসোভোর প্রাইজরেন এলাকা সফরকালে সার্বিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- “তোমরা ভুলে যেওনা যে, তুরস্কই কসোভো এবং কসোভোই তুরস্ক।” অনুরুপ ঘটনা ঘটেছিলো তুরস্কের দিক থেকে ২০১৬ সালে। তখন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর কিছুদিন পরে দেভুতুলু বসনিয়ার সার্ব এলাকা বানজালুকা’য় বসনিয়া যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদের পুনর্নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করতে যান। সেখানে তিনি বলেছিলেন- “আমরা এখানেই ছিলাম, এখানে আছি এবং এখানে অনন্তকাল ধরে থাকব।”
বলকানের এরকম আরও অনেক বিষয়ে তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ করে। যেমন, সার্বিয়ার বেলগ্রেড এবং সাঞ্জাক-এ বসবাসকারী দুটি বিবাদমান মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতা করে। অনুরূপভাবে তুরস্ক, সার্বিয়া এবং বসনিয়া হার্জেগোভিনার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষিয় শান্তিচুক্তি করার প্রস্তাব ঘোষণা করে। পাশাপাশি মেসিডোনিয়ার সাথে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। তবে, এটি গ্রীসের ক্ষতিসাধন করার জন্য করেছে ব্যাপারটি এমন নয়; বরং ব্যাপারটি এমন মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে মেসিডোনিয়া সার্বিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া এবং গ্রিসের মাঝামাঝি অবস্থিত।
এসব বিবেচনায় মনে করা হয় যে, বলকান এমন একটি অঞ্চল যেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি বেশ সফল হয়েছে। তবে, ককেশাস এবং মধ্যএশিয়া অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা রুশ প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। মনে হচ্ছে, তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে গভীর সন্দেহ এবং সুপ্ত শত্রুতা কাজ করছে, যার কারণে দেভুতোলোর “zero problems” থিওরির উপর ভিত্তি করে গঠন করা তুর্কি পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হয়।
২০১৫ সালে সিরিয়ার শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে তুরস্ক বলকানে আরও বেশী প্রভাব বিস্তার করে। শরণার্থীদের ইউরোপে প্রবেশ নিয়ে এরদোগানের হুমকির কারণে তুরস্ক এই অঞ্চলের জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। পাশাপাশি এই এলাকার মুসলমানদের মন জয় করতে সক্ষম হয়। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করার মধ্যে। শেষ দিকে এসে বলকান অঞ্চলে স্বৈরাচারী মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক নিজেকে এসব দেশের সামনে সফল ‘রুল মডেল’ হিসেবে পেশ করতে সফল হয়।
তবে, বলকানে তুরস্কের এই ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মোটেও উদাসীন নয়। ইইউর সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পর থেকে তুরস্ক এবং তার পাশাপাশি রাশিয়া বলকানে ইইউর প্রভাব হ্রাস করার জন্য প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কি অনেকের ধারণা- তুরস্ক কখনো বলকানের আলবেনীয় বংশোদ্ভূত সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি একক আলবেনিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া সত্ত্বেও বলকানকে নিজের কৌশলগত প্রভাবাধীন এলাকায় রূপান্তর করার ক্ষেত্রে তুরস্ক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমেই যে বাধাটির কথা বলতে হয় সেটি হচ্ছে- বলকানের অধিকাংশ খ্রিষ্টান দেশ মনে করে থাকে যে, তুরস্ক একটি পক্ষপাতদুষ্ট মধ্যস্থতাকারী দেশ, যেটি সবসময় বলকানের মুসলমানদের অগ্রাধিকার দেয়। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে- ২০১৩ সালে কসোভো সফরকালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তুরস্ক-সার্বিয়া-বসনিয়া’র মধ্যকার ত্রিপক্ষিয় বৈঠক থেকে বেলগ্রেড নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। বলকানে অটোমান ইতিহাসের কারণে এই এলাকার দেশগুলোর সাথে ব্যাবহারের ক্ষেত্রে তুরস্ককে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যাতে বলকানের মুসলমানদেরকে সহযোগিতা করতে গিয়ে এই এলাকার খ্রিষ্টানদের শত্রুতা ক্রয় করতে না হয়।
দ্বিতীয়ত, তুরস্ক তার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বলকানের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যে কারণে তুরস্কের অধিকাংশ মনোযোগ ও শক্তি এই এলাকায় নিঃশেষ হয়ে যায়।
তৃতীয়ত, তুরস্কের সামনে আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে। সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং গ্রীসের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতএব, এই ৩ দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলকানে তুর্কি প্রভাব মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে পারে। তাছাড়া, এই এলাকায় ইইউর তুলনায় তুরস্কের প্রভাব এখনও সীমিত। তুরস্কের বাণিজ্যিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এই এলাকায় বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবে তা পূরণ হয়নি। যতোটুকু হয়েছে তা-ও হয়েছে তুরস্কের মিত্র এলাকাগুলোতে, যেমন সাঞ্জাকে।
বলকানে তুরস্কের রাজনৈতিক সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দেশটিকে বলকান দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্র্যাগম্যাটিক রাজনীতি করে যেতে হবে। এবং এটা করতে হবে অবশ্যই অটোমান উত্তরাধিকারের বিষয়টি টেনে না এনে। কারণ, এটি এই দেশগুলোর জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়, যেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী উপনিবেশের স্মৃতি বহন করে আসছে।
এই দিক থেকে, যদি একটু সতর্কতার সাথে কাজ করা যায় তাহলে তুরস্ক এবং বলকানের পক্ষে পরস্পরের মধ্যে স্থানীয় সহযোগিতার একটি সফল মডেল পেশ করা সম্ভব হবে। তাই এই অঞ্চলে তুরস্কের উপস্থিতিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। এটা তো সত্য যে, বর্তমানে তুরস্ক তার প্রতিবেশী বলকান রাষ্ট্রগুলো থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, আঙ্কারা তার এই শ্রেষ্ঠত্বকে প্রভাবে পরিণত করতে সচেষ্ট হবে। এসব দেশের একথা খুব ভালো করে জানা আছে। পক্ষান্তরে ইইউ এবং পশ্চিমা বিশ্ব বলকান দেশগুলোর আনুগত্যকে তাদের চিরস্থায়ী সম্পদ মনে করে। দীর্ঘ সময় ধরে এগুলোকে অপেক্ষায় রেখেছে। বলকানবাসীরা ইইউতে যোগ দিতে চাইতে পারে, তবে তাদেরকে চিরকাল অপেক্ষা করে যেতে বলা যাবে না। বেটার অফারের অনুপস্থিতিতে, স্বাভাবিকভাবেই বলকানের অধিবাসীরা স্থানীয় অন্যান্য শক্তিগুলোর দিকে ঝুঁকবে। যেমন, তুরস্ক। তখন পশ্চিমারা এ কথা কখনো বলতে পারবে না যে, আমাদেরকে হুঁশিয়ার করা হয়নি।
Discussion about this post