মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান গণহত্যা নিয়ে বিএনপি আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন- রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে যে সেফ জোনের কথা ভাবা হচ্ছে, তা হবে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের জন্য বিপদজনক, ভয়ংকর ও স্বার্থবিরোধী। এর পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে চাপ সৃষ্টি করতে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
রোববার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশো’রে ‘জেনোসাইড ইন মিয়ানমার অ্যান্ড দ্য রোল অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম। প্রবন্ধের মাধ্যম তিনি রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম গণহত্যা পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন। সেমিনারে বিএনপির নেতারা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অংশ নেন। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পলিটিক্যাল অফিসার জ্যাকব লেভিন এতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রোহিঙ্গা ইস্যূতে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাখ্যান করা দুঃখজনক। এই সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে হলে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। আর এ জন্য জাতীয় ঐক্যের দরকার। বিএনপি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। কারণ, জিয়াউর রহমানের সময়ে ’৭৮ সালে ও বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে ২০০৫ সালে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তখন তাদের ফেরত পাঠিয়ে নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই দায়বদ্ধতা থেকে বিএনপি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে।
জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া না দিয়ে ক্ষমতাসীনরা দলীয় রাজনীতি করতে চাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখেন দলটির এই নীতি নির্ধারক। প্রস্তাবগুলো হলো- রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অস্থায়ীভাবে থাকতে দিতে হবে, সংকট মোকাবেলা ও সমাধানে জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে হবে, যেসব রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের এসব নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। এজন্য যথাযথ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিএনপি সরকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে অতীতের চুক্তির আলোকে সংকট নিরসন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সেফ জোন সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানান ড. মোশাররফ। তিনি বলেন, সেফ জোন হবে বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বিপদজনক, ভয়ংকর ও স্বার্থবিরোধী। আমরা এটি প্রত্যাখ্যান করছি। এ নিয়ে যেন আর কথা না হয়। সেফ জোন বিষয়টিকে আমরা ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করছি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকায় আন্তর্জাতিক মহলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, তারা মিয়ানমারের গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ গুরুত্ব দিয়ে এখনও রেজুলেশন নিতে পারেনি। আশা করি, তারা এমন পদক্ষেপ নেবে যাতে মানবিক বিপর্যয় সমাধান হয়।
সভাপতির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে গণহত্যা চালাচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব সোচ্চার হলেও বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। বিএনপির সেমিনারের মূল বিষয় হচ্ছে জনসমর্থন তৈরি করা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ সরকার এখন কোন অবস্থানে আছে সেটি পরিষ্কার নয়। রোহিঙ্গা ইস্যূতে সরকারের বর্তমান অবস্থান লোক দেখানো।
সেফ জোন প্রস্তাবের সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, সেফ জোন কোথাও কখনও কাজ করে না। কোনো দেশেই কাজ করেনি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত-চীন-রাশিয়ার বিতর্কিত ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে খসরু বলেন, ‘এই অঞ্চলের যারা বড় শক্তি তারা এক্সক্লুসিভ একটি জাতির পক্ষে কাজ করছেন। যদি ক্ষমতাধররা এই কাজ করেন তবে এটি ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থা হবে। এটি শুধু মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। মিয়ানমারের সঙ্গে হওয়া আগের চুক্তিগুলো ভিত্তি ধরে কাজ শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ’৭৮, ’৯৩, ২০০৫ সালেও এই সংকট দেখেছি। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দিয়ে বার্মিজ সরকারকে বোঝাতে হবে রোহিঙ্গারা যতই ক্ষদ্র জাতিসত্ত্বা হোক না কেন তাদের নির্মূল করা যাবে না। এটা করা গেলে অনেকাংশে সংকট কমে যাবে। সেফ জোনের কথা বলে ছাড় দিলে চলবে না।
সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল রোহিঙ্গা সংকটকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমস্যা উল্লেখ করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই তা সমাধানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারকে তাদের নাগরিত্ব ফেরত দিতে হবে এবং তাদের অধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকাকেও বৈশ্বিকভাবে রাষ্ট্রের শক্তি দেখাতে হবে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই বাড়ছে উল্লেখ করে সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় সরকার ও আন্তর্জাতিক ফোরামের উপর চাপ সৃষ্টি করতে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে কর্মসুচি দেয়ার আহ্বান জানান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঐক্যমতে আসতে হবে।
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পুরো জাতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেরা ঐক্য না করলেও সারাদেশের মানুষ এই ইস্যুতে এক। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বিশেষ করে নারী এবং শিশুরা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় আছে। ৫-১০ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। এই অবস্থায় একটি দল হিসেবে বিএনপির উচিত তাদের নিজেদেরই একটি কমিটি করে সারা পৃথিবীতে মুভ করা। কফি আনান রিপোর্টটি সারাবিশ্বে তুলে ধরা।
আলোচনায় আরো অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, জয়নাল আবেদীন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য রিয়াজ রহমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নওশাদ জমির বক্তব্য রাখেন।
নাগরিক প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করীম, খান মো. ইব্রাহিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করীম, মাহমুদ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসান তালুকদার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাইদুজ্জামান প্রমূখ রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর তাদের পর্যবেক্ষন তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি সিনিয়র নেতা নজরুল ইসলাম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবদুল হালিম, গোলাম আকবর খন্দকার, ইসমাইল জবিউল্লাহ, আবদুল কাইয়ুম, নাজমুল হক নান্নু, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, আসাদুজ্জামান রিপন, শামা ওবায়েদ, সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ, আসাদুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সদরুল আমিন, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, কুয়েত, ইরান, ফ্রান্স, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ডসহ মোট ১২টি দেশের কুটনীতিকেরা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইউএনডিপি ও ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিওরা এতে অংশ নেন।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post