এম আই খান
শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার গল্পটা বেশ পুরনো। তবুও এটা এ দেশের মানুষের মুখে মুখে প্রবাদ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এর পেছনে কারণ একটাই। আর তা হলো ধূর্ত মানুষের কোন অভাব এ দেশে কোন কালে হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি খবরের শিরোনাম দিয়ে শুরু করতে চাই। ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার শিরোনাম-“বন্যার্তদের ত্রাণের চাল বেচে খেলেন ইউপি চেয়ারম্যান।” ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম- “সাড়ে ৯ টন চাল গেল কোথায়?” ৩১ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম- “কেন্দুয়ায় ত্রাণের চাল পাচারকালে আটক তিন।” ৩১ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের শিরোনাম-“জামালপুরে ৩৪ বস্তা ত্রাণের চাল উদ্ধার।” ২৩ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার শিরোনাম-“আত্রাইয়ে সরকারি ১২৮ বস্তা চাল পাচারকালে ২জন আটক ।” ২৩ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম- “নওগাঁয় ত্রাণের চাল পাচারকালে আটক ২।”
বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে শেয়াল মামাদের নিয়ে এভাবে খবরের শিরোনাম লেখা হয়ে থাকে। আর খবরের ভেতরে যেসব তথ্য থাকে তাকে পুকুরচুরি নয়, রীতিমত মহাসাগরচুরি বললেও ভুল হবে না। গত ৩১ আগস্ট ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার শিরোনাম ছিল- “খাদ্য সঙ্কটে ভিজিএফ বন্ধের সিদ্ধান্ত।” কিন্তু কেন এই সঙ্কট? কেনইবা এই সিদ্ধান্ত? তা জানতে এর আগে ১৯ জুলাই ২০১৭ তারিখের দৈনিক যুগান্তর আপনাকে দেখতে হবে। ওইদিন দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম ছিল- “উদ্ধার ১৫৫ টন : ম্যানেজার আটক, চট্টগ্রামে গুদাম থেকে পাচার হল কয়েকশ’ টন চাল।” ওই প্রতিবেদনে জানা যায়, সাংবাদিকের কাছে তথ্য ছিলো- চট্টগ্রাম সিএসডি থেকে সোমবার রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে ২০ থেকে ২২টি ট্রাকে করে সরকারি চাল ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) ছাড়াই বের হয়ে যাবে। একই তথ্য ছিল র্যাব-৭ এর কাছেও। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে শেষ পর্যন্ত গুদাম থেকে রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে চাল বোঝাই ট্রাকগুলো একে একে বের হতে থাকে। পিছু নেয় র্যাব ও সাংবাদিক। রাতভর ২০-২২টি ট্রাক চাল বোঝাই করে সিএসডি এলাকা ত্যাগ করলেও র্যাব দৌড়ঝাঁপ করে মাত্র সাতটি ট্রাক আটক করতে সক্ষম হয়। পরে অবশ্য আরো কিছু ট্রাক আটকের খবর পাওয়া গেছে। সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে সরকারি চাল এই যে লুট শুরু হলো, তারপর আরো কয়েক জায়গায় সিএসডি লুটের একই রকম খবর বের হতে লাগলো। সর্বশেষ গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে খোদ রাজধানীতে তেজগাঁও কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামের ৯ টন চাল লোপাটের খবর পাওয়া গেল।সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে এভাবে যদি খাদ্য লুট হয়,তবে ভিজিএফ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আর কিইবা করার থাকবে?
মূলত: কী-বোর্ডে হাত দিয়েছি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ প্রকাশিত গতকালের একটি খবর দেখে। যার শিরোনাম হচ্ছে- “সংগঠন-ব্যক্তি উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ ‘নিষিদ্ধ।” যদিও খবরটি এ সময়ে প্রচার করা উদ্দেশ্যমূলকই মনে হয়েছে। কেননা এ সিদ্ধান্তটি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন গ্রহন করেছে গত মাসে। আর বাংলানিউজ এমন সময় এটি প্রচার করেছে যখন জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এবং মানবতার তাগিদে আন্তর্জাতিক সহায়তার পাশাপাশি এদেশের বেশ কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে এসেছে। খবর প্রচারের পেছনে বাংলানিউজের যে উদ্দেশ্যই থাকুক কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন না করলে তো আর খবর এমনিতেই তৈরী হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিজেদের মত করে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে পারে কিনা। যদি পারে তাহলে কোন কোন যুক্তিতে পারে?
‘ত্রান তৎপরতায় নিষেধাজ্ঞা’ জারির পেছনে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন যেসব যুক্তি দেখিয়েছে সেগুলো হলো- ত্রাণ সহায়তার আড়ালে কেউ যেন কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে না পারে সেই পরিস্থিতি তৈরি করা। পাশাপাশি বলা হচ্ছে- ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সেজন্য এর বদলে সরকার একটি সমন্বিত ও নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দু’টি যুক্তি আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও বাস্তবতার সাথে এর কতটুকু মিল রয়েছে তা যাচাই করা প্রয়োজন।
প্রথমত: অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে পুঁজি করে কেউ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা কতটুকু? যে সকল ব্যক্তি বা সংগঠনকে এই ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে এসেছে তাদের কেউই কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেনি। রাজনৈতিক মতাদর্শ একেক জনের একেকটি হলেও এখানে সবাই এগিয়ে এসেছে একান্ত মানবতার টানে। সেক্ষেত্রে মানবিক সহায়তার এ মহতি উদ্যোগকে নিষিদ্ধ করে দেয়ার মত কোন অধিকার সরকার বা জেলা প্রশাসনের আছে কি? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, এখানে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে, সেক্ষেত্রে সরকারের তহবিলে সহযোগিতার অংশ জমা দেয়ার মত আস্থা কি সরকার অর্জন করতে পেরেছে? তাহলে উপরে দেশের জনগণকে লুটে খাওয়ার যে সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি তুলে ধরেছি তার ব্যাখ্যা কি হবে? নিজের দেশের জনগণের ত্রাণ সহায়তার খাদ্য সরকারি উদ্যোগে যদি লুটেপুটে খেয়ে ফেলার শত শত নজির থাকে, তবে ভিনদেশী এসব ভাগ্যাহত মানুষের জন্য আসা দেশী-বিদেশী সহায়তা কোন বিশ্বাসে জনগণ সরকারের হাতে তুলে দেবে? এই ত্রাণ তহবিলের টাকা দিয়ে যে কোন ক্রিকেটারকে প্লট বা ফ্ল্যাটের মালিক করে দেয়া হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? বরং রাজনৈতিক ফায়দা যদি কেউ নেয়ার চেষ্টা করে তবে বর্তমান সরকারের চ্যালা চামুন্ডাদের দ্বারাই সে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটার শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। তার বাস্তব উদাহরণও মিলেছে সাম্প্রতিক সময়েই। রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশিয়ার একটি দাতা সংস্থার পাঠানো ত্রাণ এনে আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য নেজামউদ্দিন নদভী নিজের নির্বাচনী এলাকা সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় বিতরণ করেছেন বলে পত্রিকায় স্বচিত্র খবর এসেছে। তবে কি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে সরকার এসব ত্রাণের অর্থ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করতে চায়?
দ্বিতীয়ত: প্রশাসন শৃঙ্খলার যে দোহাই দিচ্ছে তার কতটুকু নৈতিক অধিকার তাদের রয়েছে? ত্রাণ তৎপরতায় শৃঙ্খলার চেয়ে এসব অসহায় রোহিঙ্গাদের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সে নিরাপত্তা দিতে প্রশাসন কতটুকু সক্ষমতার পরিচয় দিতে পেরেছে? নিরীহ এ শরণার্থীদের এই সামান্য সহায় সম্পত্তিও সরকার দলীয় ক্যাডারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। শরণার্থীদের গবাদি পশু থেকে শুরু করে নগদ অর্থ, কানের দুল, নাকের নোলক পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। তাহলে কোন শৃঙ্খলার উপর বিশ্বাস করে জনগণ তাদের সহায়তার বিষয়টি প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দেবে? যে প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা রাতের আঁধারে বন্যার্ত ও দরিদ্র মানুষের হক ত্রান ও ভিজিএফ এর শত শত টন চাল সরকারকে ফাঁকি দিয়ে লুট করে নিতে পারে, সে প্রশাসনের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়া আর শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার মধ্যে কোন তফাত থাকতে পারে কি?
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
Discussion about this post