আবু সালেহ ইয়াহিয়া
জাতীয় নির্বাচনের ঠিক একবছর আগে একটা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হল। প্রতিষ্ঠার পরের বছর নির্বাচনে গিয়েই বাজিমাত। বিজয়ী হয়ে এককভাবে সরকার গঠন করল তারা । তারপর একটিবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে চারটি নির্বাচন গেল। কোন নির্বাচনেই কেউ তাদেরকে বিরোধীদলের সারিতে পাঠাতে পারেনি। দু’দিন আগে যখন দলটি প্রতিষ্ঠার ষোল বছর উদযাপন করছে তখন তাদের সরকারে থাকার বয়স হচ্ছে ১৫ বছর। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাই না? ১৬ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই ক্ষমতায় ! তাও কোন রাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়; সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এমন দৃষ্টান্ত বর্তমান পৃথিবীতে আর আছে কি?
জি, আমি তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একেপার্টির কথা বলছি। সময়টা ১৯৯৭ সাল। তুরস্কের ক্ষমতায় তখন প্রফেসর নাজমুদ্দিন আরবাকানের দল। ইসলামিক রাজনৈতিক দল হবার অপরাধে (?) পশ্চিমের গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা তুরস্কের সেনাবাহিনীকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে সরিয়ে দিল নাজমুদ্দিন আরবাকানের সরকারকে। নিষিদ্ধ করে দেয়া হল তার দলকেও। এমন অগণতান্ত্রিক আচরণ তুরস্কে এটাই প্রথম ছিলনা। এর আগেও হয় সরাসরি ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল অথবা চাপ দিয়ে জনগণের ভোটে বিজয়ী দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পরাজিত দলগুলোকে একত্র করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার মহান দায়িত্ব (?) আঞ্জাম দেয় বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম সেনা শক্তি তুরস্কের সেনাবাহিনী।
জনগণের বিপুল সমর্থন থাকার পরেও ক্ষমতায় যেতে না পারা অথবা গেলেও ক্ষমতা থেকে বারবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার ফলে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন দলটির নেতারা। ভাবনা অনুযায়ী আবারো নতুন দল প্রতিষ্ঠা করা হলো। সেই নতুন দলের নেতাদের একাংশ আবার একটু ভিন্নমুখী চিন্তা শুরু করলেন। চিন্তাটা অাদর্শিক বিবেচনায় পুরোপুরি মানানসই না হওয়ায় অন্য অংশ তাদের সাথে একমত হতে পারলোনা খুব স্বাভাবিকবেই। ফলে যা হবার কথা ছিল তাই হলো। নতুন এ দলটি (ফাজিলত পার্টি) ভাগ হয়ে হয়ে গেল দুই ভাগে। যারা অাদর্শকে আগের মত হুবহু আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলেন তারা করলেন সাদাত পার্টি। আর যারা এ থেকে একটু ভিন্ন চিন্তা করলেন তারা প্রতিষ্ঠা করলেন একে পার্টি । এই হলো দলটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।
একে রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্নপ্রকাশ করে ২০০১ সালে। এর আগে তারা বহু মাথার ঘাম ঝরিয়েছেন। দিনের পর দিন ফিল্ড ওয়ার্ক করেছেন। প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে মত বিনিময় করেছেন। শহর থেকে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। একাডেমিক ও প্রফেশনাল গবেষকদের দিয়ে গবেষনা করিয়েছেন। এভাবে জনগণ ও গণতন্ত্রের শত্রু সেনাবাহিনীর পালস বুঝার চেষ্টা করেছেন খুব ভাল করে। সেনাবাহিনী এবং পশ্চিমা শক্তিকে খুশি করতে দলের গঠনতন্ত্রে স্থান দেয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষতাকে। নিজেদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা হলো। পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্যদের বলা হলো, এটি একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক দল। এর সাথে ইসিলামী দলের বা এজেন্ডার কোন সম্পর্ক নেই। আবার ইসলাম প্রিয় জনগণকে বলা হলো, এই ধর্মনিরপেক্ষ মানে সবাই যার যার ধর্মকর্ম সমানভাবে করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মপালনে বাধা দিতে পারবেনা। যার যেমন ইচ্ছা চলবে, যা ইচ্ছা খাবে, যেমন ইচ্ছা পরিধান করবে। কেউ ধর্ম পালন না করলে যেমনি চাপ দেয়া যাবেনা, তেমনি কেউ ধর্মীয় অনুসাশন মেনে চললেও বাধা দেয়া যাবেনা।
শুধু ধর্মীয় কারণে কোন বৈষম্য করা হবেনা। মোট কথা ধর্মচিন্তা হবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয় এবং সবাই এ ব্যাপারে থাকবে পুরোপুরি স্বাধীন। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোন পক্ষ নেবেনা। সহজ ভাবে বললে ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথা ব্যাথা থাকবেনা। কেউ কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। রাষ্ট্র এটি নিশ্চিত করবে। আর সরকারের মুল কাজ হবে উন্নয়ন, জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও সবার অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা প্রদান।
আতাতুর্কের ডিইসলামাইজেশন ও পাশ্চাত্যকরণ প্রজেক্টের ফলে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে যায় তুরকি জাতির একটি বড় অংশ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তখনও অন্তর থেকে ইসলামকে মুছে দেয়নি। দীর্ঘ ৬ যোগ ধরে প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম মানতে বাধার মুখোমুখি হওয়ায় বাহ্যিকদিক থেকে ইসলামের সাথে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে ঘটে যায় এক আমূল বিপ্লব। বোরখা দূরে থাক, হিজাব পরে অফিস আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, গাড়িতে এমনকি রাস্তায় চলা ফেরাও করতে দেয়া হতোনা। ফলে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় পশ্চিমের টপলেস- বটমলেস পোষাক হয়ে যায় তাদের পরিধেয়।
একে পার্টির র অাবির্ভাব তাদের পোশাক পরিধান ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করতে কোন অসুবিধা তৈরি না হওয়ায় এই শ্রেণীর মানসিকতা সম্পন্ন নারী ও পুরুষের একটা বড় অংশ সমর্থন জানালো তাদের। অন্যদিকে বোরখা ও হিজাব পরিধান করে বিনা বাধায় সব কাজে অংশ গ্রহণ ও সর্বত্র বিচরণের অধিকার পেয়ে ইসলামপন্থী নারী ও পুরুষের ৯০% এর বেশি মানুষ বিশ্বস্থ আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করল দলটিকে। প্রতিষ্ঠার পরের বছরই বাজিমাত করে ক্ষমতায় চলে আসার পেছনে মুল রহস্য এখানেই।
তারপর শুধু সামনে এগিয়ে যাবার গল্প। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক হবার ফলে পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী সরকারে হস্তক্ষেপ করার কোন প্রত্যক্ষ অজুহাত খোঁজে পাচ্ছিলনা দেশটির সেনাবাহিনী। একই কারণে প্রকাশ্যে তেমন সমালোচনা না করতে পেরে নীরবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে পশ্চিমা গোষ্টি। আর এই সুযোগে দলটি শতভাগ মনোযোগ দেয় উন্নয়নের দিকে। প্রথমবার ধর্মীয় কোন বিষয় নিয়ে নাড়াচড়া করেনি তারা। ব্যাপক উন্নয়ন ও ধর্মের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বড় কোন ভুমিকা দেখতে না পেরে জনগণ নির্দ্বিধায় দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতার চাবি তুলে দেয় তাদের হাতে। সেনাবাহিনীর ভিতরে চুলকানি থাকলেও কিছুই করার ছিলনা তাদের। কিন্তু এরদোয়ানসহ একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকের ইসলামি রাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় ধীরে ধীরে সমালোচনা শুরু করতে থাকে পশ্চিমাবিশ্ব। কিন্তু এসব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে উন্নয়নের দিকে আরো নজর দেয় দলটি।
যে সব জায়গায় হিজাব নিষিদ্ধ ছিল ধীরে ধীরে তুলে দিতে থাকে সে সব নিষেধাজ্ঞা। ইসলামিক প্রতিষ্ঠান গুলোতে অনুদান ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলোকে এতিম অবস্থা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফেকাল্টিতে পরিণত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে উন্নত সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন মসজিদ প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দলটি বিশ্ব মুসলমানের নানা সমস্যায় মুখ খুলতে শুরু করে।
ইসলামের পক্ষের এ ধরণের কাজগুলোই দলটিকে একটি ইসলামপন্থী দল ও এরদোয়ান একজন ইসলামী মৌলবাদী নেতা হিসেবে তকমা দিয়ে প্রচার শুরু করে পশ্চিমা মিডিয়া। প্রকাশ্যে অস্বস্তি প্রকাশ করতে থাকেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা।
এরই মাঝে চতুর্থবারের মত সরকার গঠন করে ফেলে দলটি। ফলে শুরু হয় একে পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার নানা পরিকল্পনা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ছোট বড় সন্ত্রাসী হামলা চলতে থাকে। কখনো পিকেকে আবার কখনো আইএস আইএস। পিকেকে’কে প্রকাশ্যে মদদ দিতে থাকে আমেরিকা ও ইউরোপ। এরই মাঝে ২০১৬ সাইলের ১৫ জুলাই একে পার্টির ক্ষমতায় থাকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও বড় হামলাটি করা হয়। দৃশ্যপটে আবারো সেনাবাহিনী। কারণ এই চার নির্বাচনে এতটুকু ভোট বাড়েনি ( ২৫%) প্রধান বিরোধী দলের। আর তৃতীয় বৃহত্তম দল( ১৩%)শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়ে আসছিল একে পার্টিকে।
কাজেই বিরোধী দলকে কাজে লাগিয়ে একে পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরানো এক অসাধ্য কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। কাজেই সেনাবাহিনী ছাড়া কোন বিকল্প ছিলনা একে পার্টি বিরোধী দেশী ও বিদেশী জোটের হাতে। দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয় চল্লিশ বছর ধরে কোন বাধা ছাড়া নীরবে কাজ করতে থাকা ফেতুল্লাহ গুলেনের অরাজনৈতিক শক্তিকে। কিন্তু ততদিনে বহু দুর গড়িয়ে গেছে মারমারা, ভুমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর ও বসফরাস প্রণালীর পানি। ছোট্ট একটি বীজ থেকে ১৫ বছর বয়সী এক শক্ত বটবৃক্ষ হিসেবে শিকড় ছড়াতে সক্ষম হয় দলটি। স্বয়ং সেনাবাহিনীর ভিতরেই শুরু হয় ক্যু’র পক্ষে বিপক্ষে বিভাজন।
ফলে ১৫ জুলাইয়ের রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশের এই অপচেষ্টাকে শক্তভাবে রুখে দেয় দেশটির সরকার ও জনতা। ৯৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ক্যু সফল করতে পারেনি সেনাবাহিনী। এ যাত্রায় টিকে যায় একে পার্টি। তারপর শুরু হয় ক্যু’র সাথে সংশ্লিষ্টদের ধুয়ে মুছে সাফ করার অভিযান। বিশেষ করে বারবার গণতন্ত্র ও ইসলামের যমদূত হিসেবে ভুমিকা পালিনকারী সেনাবাহিনীর মাঝে চালানো হয় ব্যাপক দমন অভিযান। এ অভিযানে পশ্চিমা বিশ্ব প্রকাশ্য নিন্দা জানালেও এবং নানাবিধ অগণতান্ত্রিক ও কুটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করলেও সে দিকে তোয়াক্কা করার যেন কোন সময়ই নেই একে পার্টির। এরই মাঝে গণভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামোতেও। প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসন পদ্ধতিতে থেকে দেশটি এখন আমেরিকার মত রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতির পথে। আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা বেড়েছে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের। মুসলিম বিশ্বেও তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে সমানভাবে।
সেই ২০০২ থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল। টানা ১৫ বছর ধরে সাত কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের দেশটির একক হর্তাকর্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে দূর্বার বেগে এগিয়ে চলছি একে পার্টি আর ১৫ বছর ধরেই বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করে চলেছে আতাতুর্কের আদর্শের ধারক প্রধান বিরোধীদল সিএইচপি। যেভাবে চলছে তাতে নিকট ভবিষ্যতেও কোন স্বাভাবিক পন্থায় এ দলকে যে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবেনা এটা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।
Discussion about this post