মাসুদ মজুমদার
দেশের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে সব কিছু ঘটে যাচ্ছে অতিলৌকিকভাবে। যেন ধর্মের কল বাতাসে নড়ছে। এ ধরনের একটি প্রবাদ-প্রবচন সব দেশে সব ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায়। যারা ধর্ম মানেন না তারাও ‘প্রকৃতি’র বরাতে এই প্রবচনে বিশ্বাস রাখেন। একটু ভাবুন এবং পেছনে তাকান, পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহ, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলে চার নেতার খুন কিভাবে ঘটে গেল! বঙ্গবন্ধুর কাছে বাঙালির প্রত্যাশা ছিল আসমানছোঁয়া। তার ওপর তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গের অনেক কারণ ঘটেছিল। রক্ষীবাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। আইনের শাসন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাই পরিবর্তন প্রত্যাশিত ছিল, সেটা ছিল একদলীয় শাসন থেকে গণতন্ত্রে ফেরার আকুতি থেকে জন্ম নেয়া। কিন্তু যা ঘটল তার ওপর দৃশ্যত জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল কি? ৭ নভেম্বর যা ঘটল তাও ব্যাকরণসম্মত ছিল না। যা কিছু ঘটেছে সে সব জানান দিয়েও আসেনি। অথচ ঘটে গেল চোখের নিমেষে। এভাবে জিয়া হত্যার বিষয়টা কি জনগণ ভেবেছিল! নির্বাচিত সাত্তার সরকারকে হটিয়ে এরশাদের মঞ্চ দখল নিয়ে কানাঘুষা ছিল। তিনি হুইসেল বাজিয়ে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা কেড়ে নেবেন- এই ভাবনা কারো ছিল বলে মনে হয়নি।
ডা: মিলন হত্যার পর তিন জোটের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এরশাদের পতন অনিবার্য ছিল। তবে গণরোষ এরশাদকে এভাবে উড়িয়ে নিয়ে যাবে- এটা কম লোকই ভেবেছিলেন। জনগণকে রাজপথে রেখে আওয়ামী লীগ-জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচন করেও এরশাদ টিকতে পারবেন না- তা কি তিনিও জানতেন? মইন ইউ আহমদ ‘গণতান্ত্রিক সামরিকতন্ত্রের’ নতুন ধারণা ‘সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার’ নিয়ে হাজির হবেন, কে জানত। তবে মইনের ভাবভঙ্গি দেখে একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, গোঁফ দেখে বোঝা যায়, ইঁদুর বিড়াল মারতে পারবে কি না। অর্থাৎ মইনের চেহারায় শাসকের কোনো প্রতিচ্ছবি ছিল না। জামায়াত নেতাদের ‘এভাবে’ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে, তা খোদ জামায়াতও ভাবেনি। বিগত সাড়ে তিন বছরে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ও খুন-খারাবিসহ এমন অনেক অঘটন ঘটল, যা দেখার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না।
কে ভেবেছিল, জামায়াত-আওয়ামী লীগ কর্মসূচির ঐক্য গড়ে তত্ত্বাবধায়ক দাবির বাস্তবতা দেবে। কারো মাথায় ছিল না, এমন কি আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাও জানতেন না, নন্দিত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা শেখ হাসিনা নিজেই উপড়ে ফেলবেন। আল্লামা শায়খুল হাদিসের দল খেলাফত মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগ সন্ধি করার ব্যাপারে কোনো ধরনের অঙ্ক মিলছিল না। যেমন অঙ্ক মেলানো যায় না হেফাজতের সাথে প্রধানমন্ত্রীর এক মঞ্চে ওঠার বিষয়টি। এই হেফাজতকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের ভাষায় ‘লেঙ্গুড়’ তুলে পালানোর নিষ্ঠুর সব ব্যবস্থা করেছিল আওয়ামী লীগ। গোলাগুলি আর অস্ত্রবাজির নাম দেয়া হবে ‘সাউন্ড গ্রেনেড’, তা-ই বা কে ভেবেছিল। জঙ্গিবাদের ‘তোহমত’ দিয়ে মাদরাসাকে ‘জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ আখ্যায়িত করেছিল আওয়ামী লীগই। মৌলবাদী আখ্যায়িত করেছিল একই দল। ফরিদউদ্দীন মাসউদকে হেফাজত মোকাবেলার জন্য আওয়ামী লীগই মাঠে নামিয়েছিল। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম আফজল ‘ওয়াহাবি ফের্কার’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন কাদের ইন্ধনে? সরকারি আনুকূল্যে বিকল্প হেফাজত বানাতে ফরিদউদ্দীন মাসউদ শাপলা চত্বরে বিশাল মজমা বসানোর ডাক দিলেন। তাতে ঘু ঘু উড়ল। সেই মাসউদ এবং মুফতি শফী সাহেব- এক মঞ্চে পাশাপাশি বসে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতার্থ করলেন। প্রধানমন্ত্রীও তাদের উপস্থিতি উপভোগ করেছেন। মুফতি শফী সাহেব গণভবনে অভ্যর্থনা পেলেন। যারা ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন, তারা এখন সনদ বিতর্কে ও জঙ্গি ইস্যুতে হেফাজতকে ডিফেন্ড করছেন। মতিয়া-মেনন-ইনুরা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হওয়া কি কম অলৌকিক বিষয়? ডুগডুগিবাজরা এখন ছিটানো থু থু চেটে চেটে খাচ্ছেন- এর সবটুকু ভোট ও ক্ষমতার রাজনীতি নয়, ধর্মের কল বাতাসে নড়ার মতো বিষয়ও বটে।
বলুন তো, কেউ কি ভেবেছিলেন, মোদির ভারত আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের মানুষের কাছে এতটা ছোট করে দেবে? পানি না দিয়ে উপহাস করবে!
কুদরত আল্লাহর হাতে। কেরামতি-মোজেজা সব কিছুর নিয়ন্তা বিধাতা। ক্ষমতা আল্লাহ দেন, কেড়েও নেন। সম্মান আল্লাহ দেন, আবার সেই সম্মান ধুলায় গড়াগড়ি দেয়ানোর মালিকও তিনি।
কওমি মাদরাসা নিয়ে যারা যতটা বাড়াবাড়িমূলক মন্তব্য করেছেন, তারাই এখন ইউটার্ন নিয়েছেন। প্রগতিশীল সাজতে এবং অজ্ঞতার কারণে ধর্মের বিরুদ্ধে মন্তব্যকারীরা না জেনে অনেক মন্তব্য করেছেন। এটা এক ধরনের অপরিণামদর্শিতা। প্রান্তিকতাও বটে। এ ধরনের প্রান্তিকতা সব সময় যুক্তিহীন হয়ে থাকে। তার পরও বলতে হবে ‘নিন্দে ফুল ফিন্দে’, যারা এক সময় নিন্দাবাদ বা পদদলিত করাকে প্রগতিশীল রাজনীতি ভেবেছেন, তারাই এখন রাজনীতির স্বার্থেই সেই ফুল গলায় তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, কওমি আলেমরাই আমাদের আজাদী বা স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করেছেন বা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে তো ইতিহাস বিকৃতি নেই। বরং ‘ইতিহাসের সত্যটাই’ প্রচারণা ও বিদ্বেষের জঞ্জাল সরিয়ে সামনে এনেছেন। এত সরলীকরণের রাজনীতি কি স্বাভাবিক ছিল? একসময় দৃঢ়তার সাথে মন্তব্য করেছিলাম, ইতিহাস ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের শাসনকালকে বাংলায় মুসলিম শাসন হিসেবে চিহ্নিত করবে। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু থাকবেন সামনের কাতারে। জিয়াও থাকবেন তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা দখল করে। মুশতাক-সায়েমও ইতিহাস থেকে বাদ পড়বেন না। বিচারপতি সাত্তারও আলোচনায় থাকবেন। এরশাদ নন্দিত নিন্দিত হয়ে উপস্থাপিত হবেন। বেগম খালেদা জিয়া হবেন বাংলার প্রথম মুসলিম মহিলা শাসক। শেখ হাসিনার শাসনকালও একইভাবে চিহ্নিত হবে। তবে তার তৃতীয় মেয়াদের শাসনকাল উঠে আসবে ‘গ্রহণকাল’ হিসেবে।
ইতিহাস বিকৃতি ঘটে রাজনীতির স্বার্থে। রাজনীতিবিদদের মাধ্যমেই আবার চেপে রাখা সত্যটা একসময় সামনে এসে দাঁড়ায়। সময়ের বরপুত্ররা ভাবেন তিনি ইতিহাসে অমর হবেন। ইতিহাসে থাকা মানেই অমরত্ব লাভ করা নয়। মানুষ ইতিহাসে থাকে দোষেগুণে, ভালোমন্দ মিলিয়ে। এটা নিশ্চিত করে বলা চলে- শেখ হাসিনার কওমিনীতি, সৌদি আলেমপ্রীতি, মূর্তিবিরোধী অবস্থান ও স্কুলসিলেবাস আলোচিত হবে তার উদার নৈতিক ধর্মনীতি হিসেবে। বামপন্থী ও এরশাদকে সাথে নিয়ে পথচলা চিহ্নিত হবে অভ্যন্তরীণ শাসননীতির কৌশল হিসেবে। নিষ্ঠুরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে একজন শাসক কিভাবে পথ চলেন- তা-ও সামনে রাখার প্রসঙ্গ উঠবে।
এ ব্যাপারে একটা উপমা দেয়া যায়, ভারতে মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ও হুমায়ুন। এর বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন আকবর ও জাহাঙ্গীর। শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব আমলে এসে মুঘল শাসন বার্ধক্যে পড়ে যায়। বাহাদুর শাহ জাফরও মুঘল শাসক ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নামেমাত্র। ক্ষমতা তত দিনে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ইতিহাস আওরঙ্গজেবকে ‘জিন্দা পীর’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সুশাসক হিসেবে তার নীতিনিষ্ঠ অবস্থানকে খেলাফত যুগের সাথে অনেক ঐতিহাসিক তুলনা করেছেন। কেউ ভাবতেন, তিনি প্রাচ্যের হারুনুর রশীদ। কিন্তু মুঘল শাসনের পতন শুরু হয় জাহাঙ্গীরের সময় থেকে। আওরঙ্গজেব সেই পতন ঠেকাতে গিয়েও ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাতের কারণে পারেননি। কারণ অথর্ব দারা, মদ্যপ মুরাদ ও দুর্বলচেতা সুজা মুঘল শাসনকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন।
শাসনকাল ও শাসক নিয়ে ইতিহাস নির্মোহ থাকার চেষ্টা করে। ইতিহাস থেকে অসংখ্য তথ্য দেয়া যাবে, যেসব তথ্য থেকে স্পষ্ট হবে- কোনো দলীয় ও বংশীয় শাসন একটা সময়ের সীমা অতিক্রম করতে পারে না। তাতে উত্থান থাকে, বিকাশ পর্ব থাকে। এর পরই থাকে পতনের সময়কাল। তখন বিদায়ের বিউগল বাজে। কিন্তু শাসকেরা ক্ষমতার চেয়ারে থেকে অনেক কিছুই টের পান না। যখন খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চান, তখন প্রকৃতির প্রতিশোধ শুরু হয়ে যায়। আপনা-আপনি ধর্মের কল বাতাসে নড়তে শুরু করে। যেমন, এখন যুক্তিহীন অনেক ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে; নিয়ন্ত্রণ থাকছে না শাসক-শাসিত কারো হাতে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। বিচার বিভাগ অস্বস্তিতে পড়েছে বলে মনে হয়; একই সাথে নির্বাহী বিভাগও বিব্রত- এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তর্কোন্দলে সরকারি দল জর্জরিত। ক্ষমতায় না থাকলে পালানোর আগাম বার্তা দিচ্ছেন দলের মুখপাত্র। বিরোধী দল হাঁটি হাঁটি পা পা করে রাজপথ ধরার চেষ্টা করছে। নির্বাচনের রাজনীতি মেরুবদ্ধ হতে শুরু করেছে। সরকারি দলের কেউ কেউ জনগণের ধারণা মতে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ মন্তব্য করছেন। ভাবছেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। নির্বাচনের আবহ সৃষ্টি হলে রাজনীতিবিদেরা সাধারণত সংযমের লাগাম পরার চেষ্টা করেন। বর্তমান ক্ষমতাকে যারা উপভোগ করছেন- তারা সেসবের ধার ধারেন না। না হলে কিভাবে বলতে পারেন, শেখ হাসিনার ‘অধীনেই’ নির্বাচন। এ ধরনের বক্তব্য না সংবিধানসম্মত, না গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন। বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদেরা কোনো দিন এভাবে কথা বলেন না- কারণ, নির্বাচন হয় নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় ও নিয়ন্ত্রণাধীন, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও নির্বাচন করেন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায়, তাহলে কি মোটাবুদ্ধির লোকেরা সরকার ডুবানোর অঙ্গীকার করেছেন- হয়তো বা তা করেননি, কিন্তু জনগণের কাছে এ বার্তা যাচ্ছে যে, এই সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণে’ নির্বাচন হবে, তাতে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হবে না। অথচ নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদেরা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করতে আগ্রহী বলেই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post