অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দলীয় অনুগত ও একান্ত বিশ্বস্ত হওয়ায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে এসকে সিনহাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তার কাছ থেকে সরকার অবশ্য যথেষ্ট প্রতিদান পেয়েছে। কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর মামলা চলাকালীন প্রতিটি শুনানিতেই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ভুমিকা ছিল রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলীদের মতো। কিন্তু, একটা পর্যায়ে এসে গনেশ উল্টে যাওয়ার মতোই সরকারের সঙ্গে এসকে সিনহার সম্পর্ক এখন অনেকটাই শীতল হয়ে গেছে। বলতে গেলে সরকার ও বিচারবিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরম আকার ধারণ করেছে।
গত বছরের ৭ নভেম্বর বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশে সরকারকে নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই মূলত এ দ্বন্দ্বের সূচনা হয়।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। এখন সরকার যদি এ বিধিমালা প্রণয়ন করে গেজেট আকারে প্রকাশ করে তাহলে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগে সরকারের তথা আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে যে ক্ষমতা আছে তা আর থাকবে না। সরকার ইচ্ছে করলেও নিম্ন আদালতের বিচারকদের ওপর আর খবরদারী করতে পারবে না। বিশেষ করে বিরোধীদলকে মামলা দিয়ে হয়রানি করার যে সুযোগটা আছে তখন আর সেটা প্রয়োগ করার সম্ভবনা কমে আসবে। এসব চিন্তা করেই সরকার এ বিধিমালাকে গেজেট আকারে প্রকাশ করছে না।
এদিকে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না হওয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিবকে গত ১২ ডিসেম্বর আদালতে তলব করেন আপিল বিভাগ। সেদিন ওই দুই সচিব আদালতে হাজির হন।
অপরদিকে, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুপ্রিমকোর্টকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে যে, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক আচরণ বিধিমালা, শৃঙ্খলা বিধিমালা ও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস বিধিমালা, ২০০৭ সংশোধনকল্পে সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবিত খসড়া গেজেটে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ওই চিঠি ওই দিন সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়।
কিন্তু, রাষ্ট্রপতির দেয়া চিঠিকে আমলে নেয়নি আপিল বিভাগ। তারা আবারো ১৫ জানুয়ারির মধ্যে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করার সময় বেঁধে দেন সর্বোচ্চ আদালত। এনিয়ে রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে বলে সেদিন উল্লেখ করে আদালত। সর্বশেষ নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সরকারকে আগামী ৮ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
এদিকে, আপিল বিভাগের দেয়া নির্দেশনা সরকার বাস্তবায়ন না করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। এনিয়ে তিনি প্রায় সময়ই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে নির্বাহী বিভাগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই এস কে সিনহা বলেছেন, একটি মহল সব সময় সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এরকম ভুল বোঝাবুঝির কারণে সাধারণ জনগণের কাছে ভুল বার্তা চলে যায়। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে পাশ কাটানো হয়েছে বলেও ওই অনুষ্ঠানে অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।
একই অনুষ্ঠানে এসকে সিনহার বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতা কারও কিন্তু কম নয়। এখন কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিন্ধান্ত নাকচ করবে, কে কাকে মানবে, না মানবে; এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই, তাহলে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না।
এর দুই দিন পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা আবার বলেছেন, কোনো সরকারই চায়না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক। তার এ বক্তব্যের কড়া ভাষায় জবাব দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, কোনো দেশে বিচারকাজ ছাড়া প্রধান বিচারপতিরা এত উষ্মা, এত কথা পাবলিকলি বলেন না। আপনার কোনো ক্ষোভ থাকলে জনসম্মুখে নয় সরকারকে বলেন।
আইনমন্ত্রী আর প্রধান বিচারপতির বাকবিতণ্ডা যখন চরম আকার ধারণ করেছে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুক্রবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পারস্পরিক দোষারোপের পথে না হেঁটে সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে সমঝোতার মাধ্যমে আরও সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার এই তিনটা স্তম্ভের মধ্যে একটা সমঝোতা নিয়েই চলতে হবে, কাজ করতে হবে। একটি আরেকটিকে দোষারোপ করে কোনোদিন একটা রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। এই বিষয়টায় সকলকে আমি একটু সচেতন থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
আইনবিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের চরম দ্বন্দ্বের মাধ্যমে প্রমাণ হচ্ছে যে, কাগজেপত্রে বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগ সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জনসমর্থন না থাকায় সরকার আদালতের মাধ্যমেই এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। দেরিতে হলেও প্রধান বিচারপতি জনগণের মনের কথাই বলছেন।
Discussion about this post