মিরাজ খন্দকার
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
নববর্ষ উদযাপন একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে মানুষ নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু করেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে রাত দিন গণনা শুরু করেছিল। কিন্তু মাস গণনার ব্যাপারটা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের ছোট-বড় হওয়া দেখে মাস গণনা করতো। এক শুক্ল পক্ষ অন্য শুক্ল পক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত একমাস ধরে মাস গণনা করতো তারা। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। আবার একদিন থেকেও সব বছর গণনা শুরু হয়নি। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপিত হয় ১লা জানুয়ারি। আবার বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয় গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে। হিজরি নববর্ষ পালিত হয় মুহাররমের ১ তারিখে। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হওয়া উচিত বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষি নির্ভর বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন দরকার কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে।
নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসও অনেক পুরনো। প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকেই পারস্যের ১১ দিনব্যাপী ‘নওরোজ’ পালিত হত। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপন হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। রোমানরা অনেক আগেই বসন্তকালের নববর্ষ উৎসব উদযাপন শিখেছিল ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে। ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা’ পালন করতো খ্রিস্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জগতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১লা জানুয়ারি Happy new year পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্ভরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পয়লা বৈশাখ’উদযাপিত হচ্ছে মাত্র কয়েক শতক ধরে।
ভারতবর্ষে মুগল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে হত, যা ছিল সবার জন্যই বিড়ম্বনার কারণ। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
মুগল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। পারস্যের (ইরানের) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ’ এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন তিনি। তার আনুকুল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনা বাজার’। আর এ মিনা বাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে ‘বৈশাখী মেলার’। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ‘নববর্ষ’ উৎসবের মূলে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও জড়িত পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
এখানে একটা প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সনের নাম বাংলা সন হবে কেন? মূলত এই সন আকবর এবং ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর আবিষ্কৃত নয়। এটি বহুবছর ধরে চলে আসা বাংলার মানুষদের মধ্যে প্রচলিত সন গণনা। বাংলার কৃষকগন সাধারণত ফসল রোপন ও ফসল কাটার জন্য এই সনের ব্যবহার করে আসছে। এদেশে মুসলিম সম্রাটরা আসারও অনেক আগে থেকেই এই সন গণনা করা হয়। ধারণা করা হয় রাজা শশাঙ্কের আমল (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই এর প্রবর্তন হয়। এটা সাধারণত শশাঙ্কব্দ নামেও পরিচিত ছিল। বাঙ্গালিদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সেই সাথে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই সনের ব্যপকতা কৃষক ছাড়া আর কারো মধ্যে ছিল না। সাধারণত হিজরি সাল অনুসারেই সব ধরণের কর্মকান্ড পরিচালিত হত। বাংলা সন অনেক পুরাতন হলেও সেখানে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের উৎসব অনুপস্থিত ছিল। সেটা চালু হয় যখন এই বাংলা সনকে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর গ্রহন করেন।
বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য সরকারি বেসরকারি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া অন্যান্য অনুষঙ্গ আমানি, রাজপূণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাস জুড়ে চলতো। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎস। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র যেত বাপের বাড়িতে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম বয়ে যেতো। বৈশাখী মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো বৈশাখী মেলায়। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল্লা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহতো ছিলই।
কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, সংস্কৃতিবিমুখতার কারণে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত বাংলা ‘নববর্ষ’ উৎসব ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়েছে। বাংলা নববর্ষে ও বৈশাখী মেলা মুসলমানদের প্রবর্তিত বাঙালি সংস্কৃতি হলেও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিস্মৃত অল্প শিক্ষিত মুসলিমরা বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে ইসলাম গর্হিত ও পাপ মনে করে। আর এ সুযোগে ইসলাম বিদ্বেষীরা অশালীন-অপসংস্কৃতিকে বাংলা ‘নববর্ষ’ উৎসবে যোগ করেছে। দেশজ সংস্কৃতির বাতাবরণে প্রতিবেশী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মঙ্গল শোভাযাত্রা, কপালে তিলক-সিঁদুর পরা, ইত্যাদি ভিন জাতীয় সংস্কৃতি যোগ হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। অধিকন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের ফলে আমাদের দেশের এলিট শ্রেণী খ্যাত কিছু অর্ধবাঙালি হোটেল-পার্কে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন Happy new year-এর আদলে। যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল ও অপদস্ত করছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রাঃ
১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা নববর্ষ উদযাপনের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে স্থান করেছে ইদানিং। চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পহেলা বৈশাখে এ শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রায় সেইবার স্থান পায় বিশালকায় চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ বিচিত্র সাজসজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। তারপরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। শুরুতে চারুকলার এ শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা পরিচিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে। তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৮৬ সালে ‘চারুপীঠ’নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
যশোরে প্রথম যে শোভাযাত্রাটি বের হয় তার উদ্যোক্তা ছিলেন চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ শিল্পী মাহবুব জামাল শামীম, হিরন্ময় চন্দ, ছোট শামীমসহ কয়েকজন। এর আগে এই উপমহাদেশে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রার তেমন একটা ইতিহাস পাওয়া যায় না। এরপর ১৯৯০ সালে বরিশাল ও ময়মনসিংহ শহরে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ প্রসঙ্গে চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “১৯৮৬ সালে যশোরের চারুপীঠের শামীম ও হিরন্ময় চন্দের উদ্যোগে প্রথম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সাজগোজ করে শোভাযাত্রা বের করা হয়। চারুকলা ইন্সটিটিউট ও চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগে আমরা ১৯৮৯ সালে ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি। তবে যশোরের চারুপীঠ এ ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। তাদের চেতনা থেকেই আমরা বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শোভাযাত্রা শুরু করি।”
শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত প্রতিমূর্তিগুলো নিছক কেবল পশুপাখির অবয়ব মাত্র নয়; বরং এর সাথে মিলেমিশে আছে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি। চলমান রাজনীতির ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত এ শোভাযাত্রা নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই একটি মহল সবসময় এদেশকে ইসলামবিমুখ করার পরিকল্পনা করে আসছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা এরই ধারাবাহিকতার একটি অংশ।মঙ্গল শোভাযাত্রা মাধ্যমে এক ধরণের কুসংস্কার সমাজে চালু হয়েছে। এই আধুনিক যুগে যেটা চিন্তাও করা যায় না। খুব সম্প্রতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু একটি টিভি টকশোতে বলেন মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমাজে মঙ্গল নেমে এসেছে। এর আগে বাংলাদেশে নাকি কোন কল্যান ছিল না। সব কল্যাণ শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার হাত ধরে।
বাংলাদেশে নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম। এদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে যা শুরু হয়েছে তা মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে সেকুলারদের সাংস্কৃতিক অবস্থান। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বড় বড় পুতুল, হুতোম পেঁচা, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ নানা জীব-জানোয়ারের মুখোশ পড়ে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ এক সাথে অশালীন পোশাক পরে অশ্লীল ভঙ্গিতে ঢোল বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করে সড়ক প্রদক্ষিণ করার রীতি চালু করা হয়েছে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।হিন্দু সমাজে শ্রী কৃষ্ণের জন্ম দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে পেঁচা, রামের বাহন হিসেবে হনুমান, দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহের মুখোশ পরে ও দেবতার প্রতীক হিসেবে সূর্য এবং অন্যান্য জীব-জন্তুও মুখোশ পরে মঙ্গল শোভা যাত্রা করে থাকে।সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো মঙ্গল শোভাযাত্রায় কার কাছে মঙ্গল চাওয়া হয়? যাদের প্রতিকৃতি নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয় তারা কি মঙ্গলে কোন ভূমিকা রাখতে পারে আসলে?
বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশী কোন সংস্কৃতির সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রার কোন যোগাযোগ নেই। এটা এক ধরণের কুসংস্কার। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এই ধরণের কুসংস্কার সৃষ্টি হওয়া এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দূর্ভাগ্যজনক। তবে আশার বিষয় হচ্ছে এদেশের সচেতন ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো এই ধরণের অপসংস্কৃতি রোধে এগিয়ে এসেছেন। এই ধরণের বিতর্কিত অপসংস্কৃতিগুলো রোধে তরুণ সমাজকে আরো বেশী এগিয়ে আসা দরকার। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। আওয়ামীলীগ তাদের দলীয় শোভাযাত্রা বন্ধ করেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য ভোলাতে ফন্দি ফিকির চলছে। জামায়াতে ইসলামী বিবৃতি দিয়ে বলেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ এবং ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।
মূলত, সংস্কৃতি জাতির প্রাণশক্তি। ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে জাতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও অভিন্ন মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বিত ও সংস্থিত। তবে বিশ্বায়নের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার আমাদের সংস্কৃতি। অন্তঃসারশূন্য বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদেরকে অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। আর অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করতে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরতে হবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন সার্থক হবে।
সহায়ক তথ্যসূত্রঃ
১- বাংলা সনের জন্ম কথা- মোঃ আবু তালিব।
২- বঙ্গাব্দের উৎস কথা- শ্রী সুনীল কুমার বন্দোপাধ্যায়।
৩- বর্ষ গণনার ইতিহাস- আবুল হাসান মাহমুদ।
Discussion about this post