১৫ বছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় চারগুণ ছাড়িয়েছে। ব্যয় বৃদ্ধির এ ধাক্কা ভর্তুকি দিয়ে মেটানো যায়নি। এজন্য দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ গত মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ে বিদ্যুতের দাম। আর বাল্ক বিদ্যুতের দাম সর্বশেষ বৃদ্ধি পায় গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। এতে বর্তমান সরকারের মেয়াদে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০ বার এবং গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। এতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮৩ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ১২১ শতাংশ।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮ সালের অক্টোবরে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দুই টাকা ৩৭ পয়সা করা হয়। এর আগে তা ছিল দুই টাকা চার পয়সা। অর্থাৎ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম ছিল দুই টাকা ৩৭ পয়সা। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ১৮২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এদিকে ২০০৯ সালের শুরুতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিল তিন টাকা ৭৩ পয়সা। বর্তমানে তা আট টাকা ২৫ পয়সা। এ হিসাবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১২১ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে ভর্তুকি কমানো হলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকলে ২০১১ সালে তিনবার বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বাল্ক মূল্যহার ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে মূল্যহার দাঁড়ায় দুই টাকা ৬৩ পয়সা। আগস্টে বাড়ানো হয় ছয় দশমিক ৬৬ শতাংশ দাম। এতে দাম বেড়ে হয় দুই টাকা ৮০ পয়সা। আর ডিসেম্বরে ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় তিন টাকা ২৭ পয়সা।
২০১২ সালেও তিনবার বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয়। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে বাল্ক মূল্যহার ১৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে মূল্যহার দাঁড়ায় তিন টাকা ৭৪ পয়সা। মার্চেই আবার সাত দশমিক ৪৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এতে বাল্ক দাম বেড়ে হয় চার টাকা দুই পয়সা। আর আগস্টে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় চার টাকা ৭০ পয়সা। তবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোয় বেশি বিক্রি করায় বাল্ক মূল্যহার কিছুটা কমে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা। এরপর কয়েক বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাল্ক মূল্যহার চার দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় চার টাকা ৯০ পয়সা। তবে সেবারও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোয় বেশি বিদ্যুৎ বিক্রি করায় বাল্ক মূল্যহার কিছুটা কমে দাঁড়ায় চার টাকা ৮৭ পয়সা। তবে ২০১৭ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রস্তাব করলেও তা বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সেবার মূল্যহার না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে দেয় বিইআরসি। সে সময় এ হার নির্ধারণ করে দেয় চার টাকা ৮৪ পয়সা।
এরপর আবারও তিন বছর বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়নি। তবে এ সময় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোয় বেশি বিদ্যুৎ বিক্রি করায় আগের মতোই বাল্ক মূল্যহার কিছুটা কমে দাঁড়ায় চার টাকা ৭৭ পয়সা। ২০২০ সালের মার্চে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার আট দশমিক ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে বাল্ক দাম বেড়ে হয় পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা। এ পর্যন্ত গণশুনানির ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করত বিইআরসি।
যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ওই মাসে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়। এতে বাল্ক দাম বেড়ে হয় ছয় টাকা ২০ পয়সা। আর সর্বশেষ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় আট দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ। এতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম দাঁড়ায় ছয় টাকা ৭০ পয়সা।
দাম বৃদ্ধির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৭ সালের বৃদ্ধির পর ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৩ পয়সা। ওই বছর মার্চে তা পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে তিন টাকা ৯২ পয়সা করা হয়। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় পাঁচ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা। ২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে সাত দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা।
এরপর ২০১৪ সালের মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ছয় টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা দুই দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় টাকা ৩৩ পয়সা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আবারও পাঁচ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ছয় টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওইবারই বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এর প্রভাবে মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় গড়ে ছয় টাকা ৭৭ পয়সা।
সংশোধিত মূল্যহারের ভিত্তিতে ২০২০ সালের মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার পাঁচ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়ায় সাত টাকা ১৩ পয়সা। এরপর থেকে বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর পরপর তিন মাসে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার পাঁচ শতাংশ করে বাড়ানো হয়। এতে মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যহার বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ২৫ পয়সা। তিনবারই গণশুনানি উপেক্ষা করে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৮-০৯ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল দুই টাকা ৫৩ পয়সা। ১৫ বছরে তা বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা চার পয়সা। এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যয় যোগ করলে বর্তমানে বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য প্রায় ১২ টাকায় পৌঁছাবে। এ হিসাবে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনলে বাল্ক বিদ্যুতের দাম প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়াতে হবে। আর বাল্ক মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে বাড়াতে হবে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম।
Discussion about this post