সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে শত শত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এএফপি’র এক তদন্তে দেখা গেছে যে, এসব নিবন্ধের লেখকদের বড় একটি অংশই ভুয়া। তাদের ছবিগুলো জাল এবং পরিচয়ও বেশ সন্দেহজনক। এমনকি বার্তা সংস্থাটির ধারণা, এসব লেখকের অনেকের কোনো অস্তিত্বই নেই। অথচ তারা স্বাধীন বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নীতিগুলোর প্রশংসা করে চলেছেন।
এএফপি’র রিপোর্টে বলা হয়, আগামী জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের আগে অজানা লেখকদের দ্বারা একটি অবিচ্ছিন্ন প্রচারণা চলছে, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে লাভবান করা। এশিয়ার সব থেকে বড় গণমাধ্যমগুলোর একটি চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা শিনহুয়া। তারাও এই ধরনের নিবন্ধগুলো প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনা সরকারের ভিন্নমত দমনের চেষ্টা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।
এএফপি তদন্তে দেখতে পায়, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্ক নিয়মিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশ্লেষণ লিখে চলেছে। তারা কেউ কেউ নিজেদের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ হিসেবে জাহির করেছেন। আবার কেউ চুরি করা ছবি নিজের বলে ব্যবহার করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক এ আল মামুন এ নিয়ে বলেন, এটি একটি সমন্বিত প্রচারাভিযান। এই নিবন্ধগুলোতে যে ধরনের লেখা প্রচার করা হয় তা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষে যায়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে অনলাইনে এ ধরনের অসংখ্য নিবন্ধ দেখা যায়। সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘প্রোপাগান্ডা’ মোকাবিলা করার জন্য ‘ভালো কলামিস্টদের’ লেখালেখি শুরু করার আহ্বান জানিয়েছিল। এএফপি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এএফপিকে বলেছেন, মন্তব্য করার জন্য তার কাছে যথেষ্ট সময় নেই।
বার্তা সংস্থাটি অন্তত ৬০টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিউজ সাইটে প্রকাশিত ৭০০টিরও বেশি নিবন্ধ বিশ্লেষণ করেছে। এগুলো মোট ৩৫ জনের নামে প্রকাশিত হয়। তাদের কাউকেই গত বছরের আগে অনলাইনে লেখালেখি করতে দেখা যায়নি। নিবন্ধগুলোতে একতরফাভাবে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি এসব নিবন্ধের কয়েকটি বাংলাদেশ সরকারের ওয়েবসাইটেও পোস্ট করা হয়।
এসব লেখার অনেকগুলোই চীনপন্থি এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ওয়াশিংটন ঢাকাকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এসব নিবন্ধের ওই ৩৫ লেখকের মধ্যে কেউ আসল বলে প্রমাণ পায়নি এএফপি। তাদের এই কয়েকটি নিবন্ধ ছাড়া আর কোনো অনলাইন উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তাদের কেউই সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই এবং কেউই একাডেমিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।
৩৫ জনের মধ্যে অন্তত ১৭ জনই পশ্চিমা এবং এশিয়ার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এএফপি’র ডিজিটাল ভেরিফিকেশন রিপোর্টাররা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। নিবন্ধে উল্লিখিত আটটি বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করেছে যে, এই কথিত লেখকদের নামও তারা কখনো শুনেনি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো, সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ লুসার্ন এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
এ ছাড়া ভারতের জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি এ নিয়ে জানিয়েছে, আমরা আমাদের রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখেছি এবং আমাদের তালিকায় এমন কারও নাম খুঁজে পাইনি। এসব নিবন্ধ প্রকাশ করা কথিত কলামিস্টদের যেসব ছবি যুক্ত করে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আটজনের ছবি অন্য মানুষের। ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারের ছবিও আছে এরমধ্যে। এএফপি এমন উদাহরণও খুঁজে পেয়েছে যেখানে একই নিবন্ধ ইংরেজি এবং বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করে প্রকাশিত হয়েছে।
এসব লেখকদের মধ্যে রয়েছেন ডোরিন চৌধুরী নামের একজন, যিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে সমর্থন করে অন্তত ৬০টি নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক সহিংসতা ‘মানবাধিকারের জন্য হুমকি’ বলে সতর্ক করেও নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি এসব লেখায় নিজের বলে যে ছবি ব্যবহার করেছেন তা ভারতীয় এক অভিনেত্রীর।
এসব নিবন্ধে দাবি করা হয় যে, তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডক্টরেট গবেষক। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই নামের কারও কোনো রেকর্ড তাদের কাছে নেই। এএফপি নিবন্ধগুলোর সঙ্গে থাকা ই-মেইলগুলোতে যোগাযোগ করে একটি প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। এতে বলা হয়, মূলত নিরাপত্তা উদ্বেগ এড়াতেই উপনাম ব্যবহার করেছিলেন ডোরিন চৌধুরী। কিন্তু ই-মেইলের লেখক তার আসল পরিচয় প্রদান কিংবা ভুয়া ছবি ব্যবহার করার কোনো ব্যাখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
আবার ব্যাংকক পোস্ট এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের একটি ব্লগ সহ বিভিন্ন আউটলেটে বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন ফুমিকো ইয়ামাদা নামের এক লেখক। তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এএফপি’র তদন্তে দেখা গেছে যে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কোনো রেকর্ড নেই। এমনকি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামের কোনো সাবজেক্টও নেই। শেখ হাসিনার প্রশংসা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে ‘দ্বিমুখী অবস্থান’ প্রসঙ্গে একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন এই কথিত বিশ্লেষক ইয়ামাদা।
অন্য নিবন্ধগুলোতেও প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের নামে ভুয়া উদ্ধৃতি যুক্ত করতে দেখা গেছে। নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজের একজন অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাকার্থি বলেছেন, পৃথ্বীরাজ চতুর্বেদীর বাইলাইনে লেখা মিয়ানমারের প্রতি ‘পশ্চিমা দ্বিচারিতা’র নিন্দা করে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তার নাম দিয়ে একটি ‘সম্পূর্ণ বানোয়াট’ উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব নিবন্ধ ছাপানো গণমাধ্যমের সম্পাদকরা বলেছেন যে, তারা লেখকদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে সরল বিশ্বাসে নিবন্ধগুলো প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের ডেইলি নিউএজ সংবাদপত্রের সম্পাদক নূরুল কবীর এ নিয়ে বলেন, তাকে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণমূলক লেখা পাঠানো হয়েছিল। এর বেশির ভাগই ছিল ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ইস্যুতে। তিনি পরে আশঙ্কা করেন যে, এই লেখাগুলো হয়তো নির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ভাড়াটে লেখকদের পাঠানো। তাই তিনি একসময় এ ধরনের লেখা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন। তবে এই লেখকরা যে একেবারেই ভুয়া তা জানতে পেরে তিনি হতবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, এই গুজব ও অপপ্রচারের যুগে লেখকদের পরিচয় যাচাই করার বিষয়ে আমার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
Discussion about this post