বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ঘূর্ণিঝড় মোখার মতো ধেয়ে আসছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে গত বছর শেখ হাসিনা ব্যয় সংকোচননীতি শুরু করেছিল। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থাকলেও সেটা এখন ২৪ বিলিয়নের ঘরে চলে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩০ বিলিয়ন হলেও আগামী ১৮ জুন থেকে রিজার্ভ গণনা হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী। তখন রিজার্ভ হবে ২৪ বিলিয়ন। আর আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ও সেপ্টেম্বরে ২৫.৩২ বিলিয়ন করতে হবে। যেটা সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
কারণ হল-তিনটি উৎস থেকে ডলার এসে রিজার্ভে যোগ হয়। এর মধ্যে প্রধান হল রপ্তানি আয়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি আয় কমছে। গত এপ্রিলে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগে মার্চে রপ্তানি আয় এসেছিল ৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতিও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৫ হাজার ৩৯৩ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৯৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য। এতে ১ হাজার ৪৬১ কোটি ৩০ লাখ (১৪ দশমিক ৬১ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। সুতরাং রপ্তানি আয় থেকে রিজার্ভে যোগ হওয়ার আপাতত কোনো ভরসা নাই।
রিজার্ভ বাড়ার আরেকটি খাত হচ্ছে প্রবাসী আয়। এটার অবস্থাও বর্তমানে খুব খারাপ। গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে মাত্র ১.৬৪ বিলিয়ন ডলার। আর মার্চে এসেছিল ২.০২ বিলিয়ন ডলার। মার্চ থেকে এপ্রিলে প্রবাসী আয় কম এসেছে। আর চলতি মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ১.১২ বিলিয়ন। মানে চলতি মাসেও কাঙ্খীত প্রবাসী আয় আসবে না। সুতরাং এখান থেকেও রিজার্ভে যোগ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। এছাড়া রিজার্ভ বাড়ার তৃতীয় খাত হল-বিদেশি লোন ও অনুদান। রিজার্ভ বাড়ানোর সব রাস্তা বন্ধ হওয়ার পর শেখ হাসিনা এখন দেশে দেশে ঘুরছে লোন ও অনুদানের জন্য। যদি কিছু আনতে পারে তাহলে রিজার্ভ কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা আছে। তা না হলে রিজার্ভ দিন দিন কমবে। তারপর, আগামী মাসে বিদেশি লোনের কিস্তি দিতে হবে ৫০ কোটি ডলার।
এদিকে রিজার্ভ দিন দিন কমার কারণে সরকারের সামনে এখন বড় সংকট হল জ্বালানি আমদানি। দেশে জ্বালানির মজুতও রিজার্ভের মতো প্রতিদিন কমছে। জ্বালানির বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় সরকার এখন নতুন করে জ্বালানিও আমদানি করতে পারছে না। জানা গেছে, ছয়টি আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের কাছে জ্বালানি তেল বাবদ ৩০ কোটি ডলার পাবে। অর্থ না পাওয়ায় এদের কেউ কেউ বাংলাদেশে তেল পাঠানো কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তেলবাহী কার্গো ‘না পাঠানোর হুমকি’ দিয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এ নিয়ে দুইটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বিপিসি বলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে জ্বালানি মূল্য পরিশোধে বিলম্ব করছে। ৯ মে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি বলেছে, দেশের বাজারে বিদেশি মুদ্রার সংকট থাকায় এবং সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সময় মতো আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে পারছে না। এর আগে গত এপ্রিল মাসে পাঠানো আরেক চিঠিতে বিপিসি বলে, মে মাসের তফসিল অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি করা না গেলে দেশব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, সেই সঙ্গে জ্বালানির মজুত বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি হল একটা দেশের প্রাণ। দেশের সব কিছুই জ্বালানির সাথে সম্পৃক্ত। জ্বালানির সংকট দেখা দিলে সকল প্রকার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আর উৎপাদন বন্ধ হলে রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন বিরোধী দলের আর আন্দোলন করতে হবে না। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
Discussion about this post