অলিউল্লাহ নোমান
মেজর জেনারেল অব. চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বিবিসি’র সাথে ইন্টারভিউতে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় রেশমা উদ্ধার নাটক নিয়ে মুখ খুলেছেন। গত বুধবার (৩ আগস্ট) বিবিসি ইন্টারভিউটি প্রচার করেছে। তিনি সরাসরি না বললেও যা বলেছেন তাতেই স্পষ্ট রেশমা উদ্ধারের ঘটনাটি সাজানো নাটক ছিল। তিনি তখন সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার পর তাঁকে উদ্ধার কাজের সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী এই ভবন ধ্বসের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার প্রক্রিয়া চালিয়েছিল। অনেক লাশ এবং আহত অনেক মানুষ উদ্ধার হয়েছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে। ঘটনার ১৭ দিন পর রেশমা নামে এক শ্রমিককে নতুন জামা পরিহিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। রেশমাকে উদ্ধারের কয়েক দিনের মধ্যেই আমার দেশ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে উঠে এসেছিল কিভাবে রেশমা নাটক সাজানো হয়েছে। এনিয়ে তখনই অনেক তোলপাড় হয়েছিল। এক দশক পরে হলেও জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এই স্বীকারোক্তি দিয়ে একটি ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছেন। তবে আমার দেশ পত্রিকায় অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের পর তখন মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী গণমাধ্যমে আমার দেশকে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে কেউ ফাউল খেলতে চাইলে পরিণতি ভাল হবে না।
আমার আলোচনা আজকে এই বিষয়ে নয়। এই ঘটনাটির অবতারণা করার কারণ রয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে আরেকটি নাটক সাজান। এই নাটক কিভাবে সাজানো হয় সেটা বোঝার জন্য বড় উদাহরণ হচ্ছে রেশমা নাটক। রানা প্লাজা ধ্বসে ধ্বংস্তূপের নিচে অনেক মানুষ আটকা পড়েছিল। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর ছিল রানা প্লাজাকে ঘিরে। কারণ, বাংলাদেশের গার্মেন্টস-এর মূল ক্রেতা হচ্ছে ইউরোপ এবং আমেরিকা। তখন বিদেশী মিডিয়া গুলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এই সমালোচনা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্যই মূলত হঠাৎ করে রেশমা নাটকের অবতারণা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা জানেন কিভাবে একটি ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে পাল্টা নাটক তৈরি করতে হয়। রেশমা উদ্ধারের পর দেশী-বিদেশী মিডিয়ার দৃষ্টি ছিল রেশমাকে ঘিরে। রানা প্লাজায় ধ্বসে শত শত মানুষ নিহতের ঘটনা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক রেশমাকে দিয়ে। আমরা বাংলাদেশীরা সামনে কোন ইস্যু পেলে সামান্য আগেরটাও সহজেই ভুলে যাই।
শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মতিউর রহমান রেন্টু ‘আমার ফাঁসি চাই’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই বইয়ে শেখ হাসিনার জীবনের অনেক অজানা অধ্যায় পেয়েছে। বইটিতে স্পষ্ট করেই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে শেখ হাসিনা কিভাবে ইস্যু তৈরি করেন। যেমন, মতিউর রহমান রেন্টুর বইয়ে ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে একটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তখন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনে ছিলেন। এই আন্দোলনে জনমত তৈরি করতে রেলগাড়িতে চড়ে দেশব্যাপী সফর করেছিলেন শেখ হাসিনা। এই সফরে খুলনা থেকে ট্রেনে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে সৈয়দপুরে যাচ্ছিলেন। ট্রেনে শেখ হাসিনার বিশেষ কামরায় দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও ছিলেন। মতিউর রহমান রেন্টুর বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, ভোর রাতের দিকে ট্রেন ঈশ্বরদীতে পৌছায়। তখন শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন সবাই তো দেখি ঘুমাচ্ছে। একটা ফাঁকা গুলি করে দাও। দেখবে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সে অনুযায়ী নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন ফাঁকা গুলি করেন। গুলির আওয়াজে সকলে ঘুম থেকে উঠেন। শুরু হয় এদিক-সেদিন ছোটাছুটি। পরের দিন পত্রিকায় খবর বের হয় শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে ট্রেনে গুলি। এনিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। খবরের মূল শিরোনামে শেখ হাসিনা ছিলেন বেশ কয়েকদিন।
এখানেই শেষ নয়। এই ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দায়ী করে পরবর্তীতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই পাবনার আদালত মামলার রায় দিয়েছে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ক্ষমতার অপব্যবহার করেই মামলার রায় দেওয়ানো হয়। শেখ হাসিনার অনুগত আদালতের রায়ে বিএনপি’র স্থানীয় ৯ নেতার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আরো ২৫ জনের হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১৩ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড। মতিউর রহমান রেন্টুর বর্ণনা থেকে এটাই স্পষ্ট যে শেখ হাসিনা তাঁর সফর সঙ্গীদের শুধু ঘুমই ভাঙ্গাননি। একই ঘটনায় বিরোধী দলকেও শায়েস্তাও করেছেন সুযোগমত। মিডিয়ার প্রচারণা তাঁর দিকে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে। আওয়ামী কথিত বুদ্ধিজীবী ও ইন্ডিয়াপন্থি সুশীলরা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী মতিউর রহমান রেন্টু এই ঘটনা বর্ণনা না করলে হয়ত: বিষয়টি আড়ালেই থেকে যেত।
দেশের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা ইতোমধ্যে মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের আমদানি এলসি আটকে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদ্যুতের লোডশেডিং প্রমান করে দিয়েছে ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে শাসক পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় তহবিল লুটপাট করে নিয়েছে। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেই এক লক্ষ কোটি টাকা নিয়েছে আওয়ামী ব্যবসায়ীরা। এই টাকা দিয়ে শেখ হাসিনার খরচ অনুযায়ী ৩টি পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল। সরকারের এই লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার চিত্র যখন মানুষের সামনে তখন দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে শেখ হাসিনা নতুন নাটক তৈরি করবেন এটাই স্বাভাবিক।
বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে অতীষ্ঠ মানুষের পাশে দাড়াতে এবং লুটপাটের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরতে বিএনপি দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছিল। ৩১ জুলাই বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল প্রতিটি জেলায়। বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশ একযোগে হামলা চালানোর খবর পাওয়া গেছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে ভোলায়। বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশ বাঁধা দেয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিতে লাঠি চার্জের পাশাপাশি টিয়ার শেল ও গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুর রহিম। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন আরো অনেকেই। আহতদের অনেকেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ অথবা ঢাকায় উন্নত কোন হাসপাতালে। এই গুরুতর আহতদের মধ্যে ভোলা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নূরে আলম ৩ আগস্ট শাহাদাত বরণ করেন।
পুলিশের এই নগ্ন আক্রমণ যে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই নগ্ন আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিদ্যুতের লোডশেডিং ও লুটপাট থেকে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেওয়ার অপচেষ্টায় রয়েছেন। এখন মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বিদ্যুতের লুটপাটের কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। সবার আলোচনা-সমালোচনা ভোলার ঘটনা নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরাও ব্যস্ত ভোলা নিয়ে।
এমন একটি নৃশংস ঘটনার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবী করতে হয়েছিল হরতাল ও কঠোর কর্মসূচির। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের শান্ত করতে বলেছেন, আগে রাজপথ দখল কর। তারপর হরতাল। কর্মসূচি ছাড়া রাজপথ দখল হবে কিভাবে সেটা বুঝে আসতেছে না। কর্মসূচি ছাড়া নেতাকর্মীরা কি নিজ উদ্যোগে রাজপথে গিয়ে শুয়ে থাকবে বা বসে থাকবেন! দুইজন জেলা পর্যায়ের নেতার মৃত্যুতে দলটি শোক পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যেন দেশের রাষ্ট্রপতি বা গুরুত্বপূর্ণ কোন মানুষ ইন্তেকাল করেছেন। কালো পতাকা উঠিয়ে বা জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে জাতি শোকে কাতর হয়ে পড়বে।
ভোলায় স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। কিন্তু দেখা যায় হরতাল চলা অবস্থায় জনগণের কষ্টের কথা বিবেচনায় নিয়ে আধাবেলা পরই বাকী আধাবেলা কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভোলার এই ঘটনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি ফায়দা নিয়েছেন। (ক) বিদ্যুতের লোডশেডিং ও লুটপাটের খবর থেকে সোশ্যাল মিডিয়াকে ভোলার দিকে নিয়ে গেছেন। (খ) বক্তৃতা বিবৃতিতে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেওয়া নেতাদের শোকে কাতর করে শক্তি পরীক্ষা করেছেন। (গ) পুলিশ গুলি করেছে অথচ, মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। পুরাতন মামলার পাশাপাশি নতুন মামলায় ভোলা নেতাদের দৌড়ের উপর রাখতে পারবেন।
লেখক: সাংবাদিক
Discussion about this post