মুজিব খুনের পর তার রাজনৈতিক বিরোধীরা উল্লাস করেছিল। তারা সারা দেশে আনন্দ মিছিল বের করেছিল। এমন একটি একটি ঘটনা ঘটবে তারা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে এমন একটি ঘটনা ঘটুক এটা তারা কামনা করতো। তার প্রতিফল দেশ দেখেছে।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের ভূমিকা নিয়ে আজকের আলোচনা। বলা চলে মুজিবের মন্ত্রীরাই মুজিব থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। কিন্তু এই গোষ্ঠীই অত্যন্ত হাস্যোজ্জল মুখে আবার মুশতাকের মন্ত্রীসভায় অংশগ্রহণ করে। আর মুশতাক তো সেই ব্যক্তি ১৯৭৩ সালে যার নির্বাচনী এলাকার ব্যালট বাক্স সব হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে এসে মুজিব নিজেই মুশতাককে জয়ী ঘোষণা করেন।
একজন মানুষ যখন স্বৈরাচার হয়ে যায় তখন তার মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ থাকে না। যারা তার তোষামোদ করে তাদেরই কেবল ভালো হিসেবে দেখে। মুজিবের হয়েছে এই দশা। মুজিবের লাশের দাফন তখনো হয় নি। অথচ মুজিবের একেবারে কাছের লোকেরাই আরেকটি মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। সমস্ত করাপ্ট লোক ছিল তার পাশে কারণ তার করাপ্ট কাজগুলো এই লোকগুলোই বাস্তবায়ন করতো।
এই লোকগুলোর মধ্যে মোশতাকের মন্ত্রীসভাতে মুজিবসহ যোগ দিতে পারে নাই ৭ জন। মুজিব বাদ দিলে ৬ জন, এর মধ্যে একজন সেরনিয়াবাত মুজিবের সাথে খুন হন। বাকী রইলো ৫ জন। এর মধ্যে একজন কামাল হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বিদেশে ছিলেন। তিনি দেশে থাকলে যে মন্ত্রীসভায় এটেইন করতো তা একপ্রকার বুঝাই যায়। লন্ডনে থাকা আওয়ামীপন্থী কিছু মানুষ কামাল হোসেনকে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতে বললে তিনি তা সরাসরি অস্বীকার করেন।
বাকী রইলো ৪ জন, তারা হলো
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি
মো. মনসুর আলী- প্রধানমন্ত্রী
এএইচ এম কামরুজ্জামান- শিল্প মন্ত্রী
আব্দুস সামাদ আজাদ- কৃষি মন্ত্রী
মুজিবের হত্যাকারীরা এই চারজনসহ তাজউদ্দিনকে পছন্দ করতেন না। তারা হয়তো এই কজনকে মুজিবের আপন চ্যালা মনে করতেন। তাজউদ্দিনসহ এই চারজন এরেস্ট হন এবং আজাদ বাদে বাকীরা খুন হন। তাজউদ্দিনকে আগেই মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে বের করে দিয়েছে কারণ সে যতটা মুজিবের মন্ত্রী তার চাইতে বেশি ইন্দিরার প্রতিনিধি।
এবার আসুন তাদের নাম জেনে নিই যারা একইসাথে মুজিবের ও মোশতাকের মন্ত্রীসভাতে ছিলেন। এমন সংখ্যা ২৩ জন।
১. খন্দকার মোশতাক আহমেদ- রাষ্ট্রপতি
২. মোহাম্মদ উল্লাহ- উপরাষ্ট্রপতি
৩. অধ্যাপক ইউসুফ আলী- মন্ত্রী, পরিকল্পনা
৪. শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার- মন্ত্রী, এলজিআরডি
৫. মো. সোহরাব হোসেন- মন্ত্রী, পূর্ত, গৃহনির্মাণ
৬. আব্দুল মান্নান- স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী
৭. শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন, বিচার, সংসদ মন্ত্রী
৮. আব্দুল মোমিন তালুকদার- মন্ত্রী, কৃষি দফতর, খাদ্য
৯. আসাদুজ্জামান খান- মন্ত্রী, বন্দর ও জাহাজ চলাচল
১০. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক- অর্থমন্ত্রী
১১. ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী- শিক্ষামন্ত্রী
১২. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী- মন্ত্রী, পররাষ্ট্র দফতর
১৩. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, বিমান ও পর্যটন
১৪. তাহের উদ্দিন ঠাকুর- প্রতিমন্ত্রী, তথ্য, বেতার, শ্রম
১৫. কে এম ওবায়দুর রহমান— প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও তার
১৬. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর- প্রতিমন্ত্রী, রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়
১৭. দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, খনিজ সম্পদ
১৮. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়
১৯. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ- প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন
২০. মোসলেম উদ্দিন খান- প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়
২১. মোমেন উদ্দিন আহমেদ- প্রতিমন্ত্রী, বন্যা, পানি বিদ্যুত
২২. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল- প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন
২৩. সৈয়দ আলতাফ হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, সড়ক যোগাযোগ।
এর বাইরে মুজিব সরকারের ডেপুটি স্পিকার আব্দুল মালেককে স্পিকার মনোনীত করেন খন্দকার মোশতাক। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীকে মন্ত্রীর মর্যাদায় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন মোশতাক।
শেখ মুজিবের হত্যাকারী সে নিজেই। সেই এই ঘটনার যুগপৎ পরিকল্পনাকারী ও শিকার। যে ত্রাস ও সন্ত্রাসের রাজত্ব সে কায়েম করেছিলো তার জন্য এই পরিণতি যথার্থ ছিলো। খেয়াল করে দেখুন যারা হত্যাকারী তারা কেউ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। তারা আবারো আওয়ামীলীগকেই ক্ষমতায় বসিয়েছে। শুধু ১০-১২ জন নেতাকে টার্গেট করে সরিয়ে দিয়েছে। আর সন্ত্রাসী মুজিবের প্রতি এতোটাই ক্ষুব্দ ছিল যে তার পুরো পরিবারকে উড়িয়ে দিয়েছে। একটা লোক কতটুকু অযোগ্য হলে এতোগুলা গাদ্দার নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে!
আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো এই খুনী চক্রকে সাথে রেখেই রাজনীতি করেছেন মুজিব খুনের সবচেয়ে বেশি বেনিফিশিয়ারি শেখ হাসিনা।
মোহাম্মদ উল্লাহকে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন শেখ মুজিব। তার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রবর্তন হয়েছিল বাকশাল ব্যবস্থা। বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে মোহাম্মদ উল্লাহকে বাকশাল সরকারের ভূমিমন্ত্রী হিসেবে নিজের মন্ত্রিসভায় স্থান দেন মুজিব। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দেন তিনি। মোশতাক তাকে উপরাষ্ট্রপতি করেন। তিনি জিয়ার সরকারেও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ৮ আগস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাকশালের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। তাকে এর আগে রাষ্ট্রপতিও বানিয়েছিলেন মুজিব। মুজিব হত্যার পর মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় ছিলেন না। ১৯৮৫ সালে তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাকশাল সরকারের শ্রম, সমাজ কল্যাণ এবং সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৫ আগস্টের পর তিনি আবারও খুশি মনে যোগ দিয়েছেন মোশতাকের সরকারে। দায়িত্ব পান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পতনের পরে তিনি জিয়ার আমলেও মন্ত্রী হন। এরশাদের আমলেও মন্ত্রী ছিলেন তিনি। পরে তিনি আবারও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
মুজিব সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরও (ময়মনসিংহ) আইনমন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তবে মোশতাকের পতনের পর ১৯৭৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
মুজিবের মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন পদচ্যুত হলে অর্থমন্ত্রী হন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি বাকশাল সরকারেও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অন্যদের মতো অধ্যাপক মল্লিকও মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। অবশ্য মোশতাকের পতনের পর তিনি ফের শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান, যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীকে বাকশাল সরকারে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মুজিব। শিক্ষাবিদ মোজফ্ফর আহমদ চৌধুরীও মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৭৮ সালে মারা যান।
মুজিবের মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য এলজিআরডি মন্ত্রী ফণী ভূষণ মজুমদার (মাদারীপুর) মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি ১৯৭৮ সালে ফের আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। এর আগে তিনি ১৯৭৭ সালে গ্রেফতারও হন। তিনি ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।
মুজিব সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল) মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। দায়িত্ব পান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পরে তিনি ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে মারা যান।
সোহরাব হোসেন (মাগুরা) ছিলেন মুজিব সরকারের পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাক সরকারের পতনের পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা যান।
মুজিব সরকারের খাদ্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী আবদুল মোমিন (নেত্রকোনা) মোশতাকের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আসাদুজ্জামান খান (কিশোরগঞ্জ) ছিলেন মুজিব মন্ত্রিসভার পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনিও যোগ দেন বাকশালের মন্ত্রিসভায়। পান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। মোশতাকের পতনের পর তিনি ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে। ১৯৭৯ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান।
বাকশাল সরকারের ডাক, তার ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান (ফরিদপুর) মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। মোশতাকের পতনের পর তিনি জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির মন্ত্রিসভারও সদস্য হয়েছিলেন। জেল হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে মামলায় খালাস পান।
দেওয়ান ফরিদ গাজী (সিলেট) বাকশালের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও তিনি একই পদ মর্যাদা পান। পরে তিনি আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মুজিবের শাসনকালে জাতীয় সংসদের চিফ হুইফ ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (মুন্সীগঞ্জ)। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ভূমি ও বিমান মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। পরবর্তী সময় এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হন। সর্বশেষ তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। জেল হত্যা মামলার আসামি শাহ মোয়াজ্জেম খালাস পান।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম) ছিলেন বাকশালের শিল্প ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। জেল হত্যা মামলায় আসামি ছিলেন। তিনিও বেকসুর খালাস পান।
তাহের উদ্দিন ঠাকুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) বাকশালের তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মর্যাদা ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরে তিনি জিয়া ও এরশাদ সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে তাহের ঠাকুরের সম্পৃক্ততা ছিল। জেল হত্যা মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাহের ঠাকুর এ মামলা থেকে খালাস পান।
মোসলেমউদ্দিন খান হাবু মিয়া (মানিকগঞ্জ) বাকশালের পাট প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও পাট প্রতিমন্ত্রী হন। মোশতাকের পতনের পর ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। পরবর্তী সময় মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বাকশালের রেল ও যোগোযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর (পিরোজপুর)। অবশ্য বাকশাল সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়। খন্দকার মোশতাক তার মন্ত্রিসভায় মঞ্জুরকে জায়গা দেন। দায়িত্ব পান একই মন্ত্রণালয়ের। পরবর্তী সময়ে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। জিয়া সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯৬ সালেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মঞ্জুরের অপসারণের পর সৈয়দ আলতাফ হোসেনকে (কুষ্টিয়া) রেল প্রতিমন্ত্রী করেন মুজিব। ন্যাপ নেতা আলতাফ বাকশাল গঠনের সময় দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাকশালে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হন। অন্যদের মতো আলতাফ হোসেনও যোগ দেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। দায়িত্ব পান একই মন্ত্রণালয়ের। মোশতাকের পতনের পর তিনি ন্যাপে ফিরে আসেন। মোজাফফর ন্যাপের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বাকশালের সাহায্য ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ডা. ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডল (পিরোজপুর)। তিনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায়ও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত এবং পরবর্তী সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত। পরে ডা. ক্ষিতিশ জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন।
বাকশালের বন, মৎস্য ও পশুপালন প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া (রংপুর) মোশতাক সরকারের একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। মোশতাকের পতনের পর ভোলা মিয়া বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন।
মোশতাকের মন্ত্রসভায় একমাত্র নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হন মোমিন উদ্দিন আহমদ (খুলনা)। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি পান যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের। পরে তিনি বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।
মুজিব বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদ জানান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল এম এ জি ওসমানী। প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। তিনি মোশতাকের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন।
খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হন। মোশতাকের পতনের পরে মহিউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালের ৮ আগস্ট তিনি দল থেকে বহিষ্কার হলে বাকশাল গঠন করে তার চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৩ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।
মোশতাক ক্ষমতায় এসে আগের জাতীয় সংসদই বহাল রেখেছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। স্পিকার হিসেবে বিদেশে স্পিকারদের একটি সম্মেলনেও যোগ দেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মালেক উকিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আসার আগ পর্যন্ত।
বকশাল সরকারের সময় সংসদে হুইপ ছিলেন আবদুর রউফ (নীলফামারী)। ওই সরকারের চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মোশতাক প্রতিমন্ত্রী করার পর শূন্য হওয়া চিফ হুইপের পদে আবদুর রউফকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে অন্যদের মত আবদুর রউফও আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে পরে তিনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যুক্ত হন। তিনি গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১১ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
মুজিবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৫ আগস্টের আগে সরকারি কাজে বিদেশ সফরে ছিলেন। হত্যার খবর পাওয়ার পর তিনি দেশে আসতে অস্বীকৃতি জানান। মুজিবের জীবিত দুই কন্যার একজন তখন ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে বললেও তখন তা করেননি ড. কামাল। অবশ্য দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরে দল ত্যাগ করে নিজেই নতুন দল গঠন করেন। বর্তমানে তিনি গণফোরামের সভাপতি।
বাকশাল সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ (সিলেট)। তিনি মোশতাকের সরকারে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। যার কারণে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তাকেও কারাগারে যেতে হয়। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পরই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।
Discussion about this post