পাকিস্তান আমলের ইস্টার্ন রিফাইনারি দিয়েই চলছে বাংলাদেশের তেল শোধন। স্বাধীনতার পর থেকে গত পঞ্চাশ বছরে এদেশে কোনো তেল শোধনাগার তৈরি হয়নি। বাড়ানো হয়নি ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতাও। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমরা ছিলাম ব্রিটিশদের অধীনে। আমাদের দেশে অর্থাৎ বাংলায় ১৭৫৭ সালে যত শিল্প কারখানা ছিল তা সব বন্ধ করে দিয়েছে ইংরেজরা। এরপর প্রায় ২০০ বছর এখানে কারখানা তৈরি ও উদ্যোক্তা হওয়া নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তান আমলে অল্প সময়ে প্রচুর সরকারি ও বেসরকারি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলাকে শিল্পায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়। বিদেশী ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বিভাগভিত্তিক উন্নতমানের হোটেল, দ্রুত পরিবহনের জন্য হেলিকপ্টার সার্ভিস ভর্তুকি দিয়ে চালু করে।
তারই অংশ হিসেবে East Pakistan Industrial Development Corporation গঠন করা হয় ১৯৫৩ সালে। এখানের সরকারি বেসরকারি কারখানাগুলো যাতে তেল নিয়ে ঝামেলায় না পড়তে হয় এবং এখানেই যাতে তেল পরিশোধন করতে পারে সেজন্য East Pakistan Industrial Development Corporation একটি তেল শোধনাগার গড়ে তোলে।
এতে পাকিস্তান সরকারের বা East Pakistan Industrial Development Corporation -এর ইনভেস্টমেন্ট ছিল ৩৫%। যেহেতু তখন মিয়ানমারের শোধনাগার ছিল না, তাই মিয়ানমারকেও এই প্রচেষ্টার সাথে সংযুক্ত করা হয়। তাদের থেকেও ৩৫% শেয়ার নেওয়া হয়। আর বাকী ৩০% শেয়ার বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৬৮ সালে এই তেল শোধনাগারটি তার যাত্রা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে নাম রাখা হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড।
১৯৭১ সালে এই তেল শোধনাগারে বিমান থেকে বোমা হামলা করে ইন্ডিয়া। যেসব কারনে সেনাবাহিনী দ্রুত ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করে তার মধ্যেও এটিও গুরুতর কারণ। ইস্টার্ন রিফাইনারি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও সমস্ত মজুদ তেল পুড়ে যায়। নিয়াজী তার তেলের মজুদ হারিয়ে ফেলে।
১৯৬৮ সালে এই শোধনাগারটি পূর্ব পাকিস্তানের তেলের যোগান সামাল দেওয়ার পরও যাতে বার্মা ও আশপাশের তেলের যোগান দিয়ে অর্থ আয় করতে পারে সেই পরিকল্পনা অনুসারে তৈরি করা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় ইস্টার্ন রিফাইনারি গত ৫০ বছরে তার সক্ষমতা বাড়াতে পারেনি। অন্যদিকে তেলের চাহিদা বেড়েছে বহু বহুগুণ। বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে আরেকটি তেল শোধানাগার তো তৈরি করতে পারেনি, ইস্টার্ন রিফাইনারিকেও আপডেট করতে পারেনি।
ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল শোধনের সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। বছরে জ্বালানি চাহিদা ৬৫ লাখ টন। ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-কে উচ্চমূল্যে শোধনকৃত ডিজেল কিনতে হয়। আরো দুর্ভাগ্য শুধু শোধন ক্ষমতা নয়, এর মজুদ ক্ষমতাও বাড়ানো হয় নি। ফলে দাম কমের সময় যে একটু বেশি কিনে মজুদ করবে সেই ব্যবস্থাও নেই।
দেশে জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা না বাড়ায় বেশি পরিমাণে ডিজেল আমদানি করতে হয়। এতে প্রতিবছর বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। এখন চাপে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা চলছে। অথচ ৫০ বছরেও দেশে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়েনি। এর মধ্যে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নেওয়া প্রকল্পটি ১০ বছরেও অনুমোদিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ২৪ কোটি ডলার সাশ্রয় হতো। এখন বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
জ্বালানি তেল পরিশোধনক্ষমতা বাড়াতে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল-২’ নামের প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এরপর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ১০ বার সংশোধন করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে।
১০ দফা ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে ইআরএল-২ বাস্তবায়নে খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। শুরুতে এটি ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। চালুর পর মাত্র ৪ বছর ৯ মাসের মধ্যে এ টাকা উঠে আসবে বলে ডিপিপিতে বলা হয়েছে।
তবে শুরু থেকে বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এরপর সরকারের অর্থায়নের অপেক্ষায় থেকে কেটে যায় আরও কয়েক বছর। এখন বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু সেটি কবে হবে, কেউ জানে না।
Discussion about this post