উন্নয়নের গালগল্প বলা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে দেশব্যাপী লোডশেডিং ও গ্যাসের তীব্র সংকটে দেশের মানুষের অবস্থা নাকাল। গত কয়েকদিনে রাজধানীসহ দেশের সব জেলায় প্রতি ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র গরমে বিদ্যুৎ বারবার চলে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন দেশের মানুষ। অথচ গত এক যুগে উন্নয়ন, শতভাগ বিদ্যুতের সক্ষমতা অর্জনের গালগল্প শুনিয়ে আসছেন শেখ হাসিনা। তাঁর সেই উন্নয়নের ফানুস যেন চুপসে গেছে।
রাজধানীতে প্রতি ঘণ্টার বিরতিতে বিদ্যুতের যাওয়া-আসা হলেও, ঢাকার বাইরের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়ে। বিদ্যুৎ যায় না, কখন আসে এটা এখন মানুষের প্রশ্ন। অনেক গ্রাম-গঞ্জে দিনভর বিদ্যুতবিহীন থাকতে হয় মানুষকে।
গত সোমবার (৪ জুলাই) সারা দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। কিন্তু, এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
সরকারি হিসাবে লোডশেডিং সাড়ে ১২শ মেগাওয়াট বলা হলেও বাস্তবে এটি আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে বলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সূত্রে জানা গেছে।
রাজধানী ছাড়াও কয়েকদিন ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, কোণাবাড়ি, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ এলাকার পোশাকসহ অন্যান্য কারখানায় উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মত বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে:
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান গণমাধ্যমকে জানান, তারা দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা জানান, দুই-তিন দিন ধরে তারা বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সংস্থাটি ১৬৫০ মেগাওয়াট চাহিদার মধ্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে। এতে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণকারী অন্য সংস্থা ডেসকোর এক কর্মকর্তা জানান, সর্বোচ্চ চাহিদা ১ হাজার মেগাওয়াট। তারা ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। এলাকাভেদে তিন থেকে চারবার আধা ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাবি আগের তুলনায় গত ২-৩ দিন পিডিবি তাদের গড়ে দুইশ থেকে কোথাও কোথাও ৭-৮শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম দিচ্ছে। যার কারণে তাদের লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।
পিডিবির দাবি গত ২-৩ দিন ধরে গ্যাস সংকটে তারা সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন না।
গ্যাসভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও জ্বালানি না থাকায় তারা উৎপাদনে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় হঠাৎ এই সংকট তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, এই সংকট আরও ২-৩ দিন থাকতে পারে।
এদিকে গ্যাসের সংকট বেড়ে যাওয়ায় বাসাবাড়ি ও শিল্প-কলকারখানায় ভোগান্তি বেড়েছে। সকাল থেকেই চুলা জ্বলছে না অধিকাংশ বাড়িতে। কলকারখানাগুলোয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গত ১৫ দিনে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ৫০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করেছে সরকার। এজন্য দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে আবাসিক শিল্পকারখানাসহ বিদ্যুৎ খাতে। গত জুনের শেষ সপ্তাহে স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি কেনা হয় ইউনিট প্রতি (এমএমবিটিইউ) ২৫ ডলারে তা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০ ডলার। ফলে লোকসান কমাতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। যার কারণে এর চাপ পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
পেট্রোবাংলা বলছে, এক সপ্তাহ ধরে দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে দিনে ৩৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত ২০ জুন পেট্রোবাংলা দিনে ৩১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া গেছে ৮৩ কোটি ঘনফুট। ওইদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়। তারপরও গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল এক হাজার ২৬৯ মেগাওয়াট।
৩০ জুন পেট্রোবাংলা সরবরাহ করে ২৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস, এর মধ্যে এলএনজি থেকে মিলে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট। রোববার গ্যাস সরবরাহ নেমে আসে ২৮২ কোটি ঘনফুটে। এলএনজি থেকে পাওয়া যায় মাত্র ৪৯ দশমিক ৬ কোটি ঘনফুট। এদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হয় ৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গ্যাস সংকটে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে।
সরকারি তথ্যমতে সারা দেশে ৮১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে সারা দেশে। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাবে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট।
রাজধানীর বাইরে ভয়াবহ সংকট:
এদিকে রাজধানীর পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও বিদ্যুৎ সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)।
দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজাহারুল ইসলাম জানান, তারাও বিদ্যুৎ কম পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ৬৪০ মেগাওয়াট। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, তারা ৯০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন।
দুই বিভাগের ১৬টি জেলায় কোম্পানিটির ২০ লাখ গ্রাহক রয়েছে। প্রতিবছর এমনিতেই এসব অঞ্চলের বিদ্যুতের গ্রাহকদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী ও রংপুর দুই বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রাজশাহীতে ১ হাজার ৩০০ ও রংপুরে ৬০০ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যায় না।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের রুরাল পাওয়ার কোম্পানির (আরপিসিএল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ২১০ মেগাওয়াট। গ্যাস স্বল্পতার কারণে বর্তমানে গ্রিডে ১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ দিতে পারছে। তাছাড়া জামালপুর জেলায় পাওয়ার প্যাকের ৯৫ মেগাওয়াটের একটি পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ রয়েছে। ফলে সেখান থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে না। মূলত এ কারণে ময়মনসিংহ বিভাগে তার প্রভাব পড়ছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল রাতে। এ সময় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর আগের রেকর্ড ছিল ১২ এপ্রিল। ওইদিন ১৪ হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
উন্নয়নের ফুটো বেলুন:
দেশের মানুষ যখন বিদ্যুৎ সংকটে দিশেহারা, তখন পদ্মা সেতুতে বিধি ভেঙ্গে পুত্র-কন্যাকে নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত শেখ হাসিনা। দিনের পর দিন উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা হলেও নানান চাপে এখন দিশেহারা দেশের মানুষ।
একদিনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ভয়াবহ উর্ধ্বগতি, অপরদিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বিচারহীনতায় সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব বিলীনের পথে।
এর উপর জুটেছে তীব্র গরমকালে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং।
রাজধানীবাসীরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ডের মিথ্যা গালগল্প প্রকাশ হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে লোডশেডিং কম হলেও, ঢাকার বাইরে দিনভর বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
প্রতিমন্ত্রীর দুঃখপ্রকাশ:
এদিকে, বিদ্যুতের লেজেগোবরে অবস্থায় যখন জনগণ ফুঁসে উঠছে, তখন নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
ফেসবুকে নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে।
তিনি লেখেন, যুদ্ধের প্রভাবে (রাশিয়া-ইউক্রেন) আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ সব দেশকেই সমস্যায় ফেলেছে। বিষয়টি বাংলাদেশকেও বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে তিনি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন।
সূত্র: আমার দেশ
Discussion about this post