রোজা শেষ দিকেই বাড়তে থাকে ভোজ্য তেলের দাম। ঈদ সামনে রেখে ভোজ্যতেলের কারসাজিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের জনগণ। তবে শুধু ভোজ্য তেল নয়। বাজারে এমন কোনো পণ্য মিলবে না যার দাম দিনে দিনে বাড়েনি। চাল-ডাল-আটা-ডিম থেকে শুরু করে সব পণ্যের দামই এখন হু হু করে বাড়তির দিকে। ডলারের দাম বাড়ায় সব আমদানি পণ্যের দামও বাড়ছে প্রতিদিন।
অথচ উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনও তেল ছাড়া রান্নার কথা বলছেন, কখনও বা বাদামের তেলে রান্নার পরামর্শ দিয়ে জাতির সঙ্গে তামাশা করেই চলেছেন।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত রাজধানী কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে কোনো ভোগ্যপণ্যের দামই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাগালের মধ্যে নেই। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।
রাজধানীর অন্যতম বৃহত্তম পাইকারি কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারে চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মসলা পণ্য, মাছ-মাংস, ডিম, শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ, চিনি এমনকি লবণের দামও বেড়েছে। কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কেনার আশায় এই বাজারে আসা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অনেক ক্রেতাকে খালি থলে হাতে ফিরে যেতে দেখা গেছে।
রেজা হোসেনের বাসা রাজাবাজারে। কিছুটা সস্তার আশায় কেনাকাটা করতে এসেছিলেন কারওয়ান বাজারে। তিনি বললেন, আগের সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে কোনো পণ্যের দামই কমেনি। ক্রেতারা পণ্যের সরবরাহ কম অজুহাত দেখিয়ে বেশি দাম চাচ্ছেন।
এক পাল্লা আলু কিনে খালিদ হোসেন জানালেন, এলাকার দোকানের চেয়ে দামে সামান্য হেরফের। কিন্তু, এটা রিকশায় বাসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেয়ে এলাকা থেকে কিনলেই সাশ্রয়ী হতো।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) জরিপ অনুযায়ী, মঙ্গলবার গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চাল ২ টাকা, আটা-ময়দা ৮-১০, ভোজ্যতেল ৩০-৩৫, মসুর ডাল ১০, আলু ৫, পেঁয়াজ ১৫-২০, রসুন ৬০, আদা ৪০, হলুদ ২০, শুকনা মরিচ ২০, মাছ-মাংস ১০-২০, দুধ ৩০, চিনি ৪, প্রতি হালি ডিম ৮ টাকাসহ মোট ১৫টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে; যা ভোক্তার প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য।
আর এসব পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে এক শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। এই জরিপ টিসিবি রাজধানীর কাওরান বাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজারসহ ১৩টি খুচরা বাজারের পণ্যের মূল্য যাচাই করে তৈরি করেছে।
কনজ্যুমার ফোরাম সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ায় দেশের বাজারেও প্রভাব পড়বে, এটাই স্বভাবিক। তবে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, তার দাম কেন বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এখন বাড়লে এই দামের এলসি করা পণ্য দেশে আসতে আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। কিন্তু বিক্রেতাদের আজ বাড়লে আজই বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। যার কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি তদারকি সংস্থা এ বিষয়টি সামনে রেখে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনেনি। ফলে বিক্রেতারা কারসাজি করতে সাহস পাচ্ছে। তাই বাজার তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। আইন যা আছে, তা প্রয়োগ করতে হবে। শুধু জরিমানা করে ছেড়ে নয়, কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, পণ্য নিয়ে কারসাজি রোধে বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এবার অসাধু পন্থায় পণ্যের দাম বাড়ালে জরিমানার সঙ্গে জেলে দেওয়া হবে।
রাজধানীর হাতিরপুল এলাকার কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. রাশেদ হোসেন বলেন, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকা, যা এক মাস আগে ৪৬ টাকা। প্রতি কেজি বিআর ২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৫৪-৫৫ টাকা। তিনি জানান, এই বোরো মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি বড় কিছু কোম্পানি চাল ব্যবসায় নামায় তারা ধান মজুত করছে। যে কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. রমজান আলী বলেন, সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে আমদানি করা পণ্য বেশি। তিনি বলেন, মঙ্গলবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা, যা এক মাস আগে ১৭০ টাকা ছিল। মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি খোলা আটা ৬ টাকা বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খোলা ময়দা ৮ টাকা বেড়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট দানার মসুর ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১৪০ টাকা বিক্রি হয়েছে।
মাসের ব্যবধানে আলুর দাম ৫ টাকা বেড়ে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা, যা মাসের ব্যবধানে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি দেশি রসুন ৬০ টাকা বেড়ে ১২০ এবং আমদানি করা রসুনে ৩০ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ ২০ টাকা বেড়ে ২২০, আমদানি হলুদ ২০ টাকা বেড়ে ১৬০-১৮০, আমদানি আদা ৪০ টাকা বেড়ে ১৪০, চিনি ৫ টাকা বেড়ে ৮৫, গুঁড়া দুধ ৩০ টাকা বেড়ে ৭০০ এবং লবণ ৫ টাকা বেড়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। সঙ্গে পরিবহণ খরচের মধ্যে জাহাজ ভাড়া বাড়ায় আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে।
এছাড়া, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মধ্যে সাবান, টুথপেস্ট, বিস্কুট, চানাচুর, পাউরুটি, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল প্রভৃতির দামও বেড়েছে। ৩০ টাকা লাইফবয় সাবান এখন ৪০ টাকায় বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা।
৮৫ টাকার এক কেজি হুইল পাউডারের দাম এখন ১০০ টাকা। ১০০ টাকার পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট এখন ১২০ টাকা। ছোট সাইজের অ্যানার্জি বিস্কুটের দাম ৩০ টাকা, যা আগে ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি প্যাকেট চানাচুর বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা, যা আগে ৩৫ টাকা ছিল। ৪০০ এমএলের অ্যারোসল ৪৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ৪০০ টাকা ছিল।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজারে পণ্য কিনতে আসা শারমীন জাহান বলেন, সব ধরনের পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। সবকিছুতে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু আয় আগের মতোই রয়েছে। চাল, ডাল, তেল, মাছ-মাংস সব পণ্যের দাম বাড়তি। সকাল ও বিকালের নাশতা পণ্যের দামও বাড়ছে হুহু করে। সাবান-ডিটারজেন্টসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সূত্র: আমার দেশ
Discussion about this post