অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনকে জেরা, অপমান ও অবরুদ্ধ করে রাখে ও মানসিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, ছাত্রলীগ নেতারা নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন ওই শিক্ষককে।
এ ঘটনার পর কুয়েটের সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন না ঘোষণা দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুরে এ ঘোষণা দেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এর আগে সকালে কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নেননি।
মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান কুয়েট শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেন। তিনি কুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ও লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন।
বুধবার সকাল ১১টার দিকে একটি সাধারণ সভা করে কুয়েট শিক্ষক সমিতি। এতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু সমাধানের আগ পর্যন্ত সকল ক্লাস ও ল্যাব কার্যক্রমে শিক্ষকেরা অংশ নেবেন না। এ ছাড়া শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু বিচারের দাবিসহ তাদের কয়েকটি দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তারা ক্লাস ও ল্যাব বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
দাবিগুলো হল, শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আগামী ৫ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তন করে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তদন্ত সদস্যদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তদন্ত কমিটির সদস্যদের তালিকা নোটিশ বোর্ডে টানাতে হবে। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের আজীবন ছাত্রত্ব বাতিলসহ বহিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিহত শিক্ষকের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতিটি হলের সকল অংশ সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকদের নিরাপত্তায় সিকিউরিটি গার্ড নিযুক্ত করতে হবে। লালন শাহ হলে যে কারণে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে।
কুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হয়েছে। বর্তমান ছাত্রলীগ সভাপতি সরকারি চাকরি পাওয়ার পর পরই নতুন কমিটি আসার আগমুহূর্তে সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে পড়েছে কয়েকটি উপদলে। এর ভেতর একটি প্রভাবশালী উপদল বর্তমান কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, সম্প্রতি কুয়েটের লালন শাহ হলে ছাত্র আবাসিক হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য-ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে, সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান প্যানেলের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। ওই প্যানেলের সদস্যরা হলের প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায়, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একটি ক্যাডার গ্রুপ ক্যাম্পাসের রাস্তা হতে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা করা শুরু করে। সেজানের নেতৃত্বে আরো ছিলেন, কামরুজ্জামান রাহাত-এমই-১৬, জাহিদুর হাসিব-এমই-১৬, তাহমিদুল ইশরাক সিই১৬, আহসান হৃদয় আইইএম-১৭,সাদিকুল ইসলাম বিপুল আইইম-১৭, কবির হোসেন ইএফএম-১৭, সাফিন আহমেদ ইএফএম-১৭, মুন্না এলই-১৫, নাইম অন্তু এমএসই-১৬, আওয়াল আইইএম-১৭, ফয়সাল আহমেদ রিফাত এমই-১৬, মাহমুদুল সিই-১৬, নাইমি ইমতিয়াজ এমএসই-১৬, মাইন মুনতাসির-এমএসই-১৬, প্রান্ত এমএসই-১৭, খালিদ সাইফুল্লাহ শুভ্র- সিই-১৬, নাফি সিএসই-১৭, মাহবুবুর রহমান রাফি সিই-১৭, মুন্না সিএসই-১৭ ও রিয়াজ খান নিলয় সিএসই-১৬সহ অরো অনেকে।
পরবর্তীতে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষ (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) এ প্রবেশ করে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠক করেন। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ও অসুস্থ হয়ে যান ওই শিক্ষক।
পরবর্তীতে, শিক্ষক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস নিকটস্থ বাসায় যাওয়ার পর ২টা ৩০ মিনিটে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে, দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কয়েকজন ছাত্র জানান, সেলিম স্যার একজন অত্যন্ত সজ্জন সৎ মেধাবী শিক্ষক। ছাত্রবান্ধব হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অল্প বয়সে তিনি দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ২০২০ সালে অধ্যাপক পদোন্নতি পান। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নম্বরে একাধিক বার তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন তোলেননি।
কুয়েট ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালক ড. ইসমাইল সাইফুল্লাহ বলেন, ‘এ ঘটনায় ড. রজিবুল আহসানকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত তাদের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
Discussion about this post