এম আবদুল্লাহ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। নিপীড়নমূলক এই আইনের সমালোচনায় এখনো মুখর মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিয়ে কর্মরত দেশ-বিদেশের ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ আইনটি পাসের আগে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্নতা। ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে সাইবার ক্রিমিনালদের অপরাধ রোধের পরিবর্তে বহুল বিতর্কিত আইনটির যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা গেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভিন্নমতের সাংবাদিক ও সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে।
সরকার ও তাদের অন্ধ অনুসারী ছাড়া প্রায় সব মহলে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাপরিপন্থী ধারাগুলো ধিকৃত হয়েছে। আইনটি বাতিলের জোরালো দাবি উঠেছে দফায় দফায়। বিশেষ করে এই আইনে লেখক মোস্তাক আহমদের গ্রেফতার এবং কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের পক্ষ থেকে আইনের অপপ্রয়োগ রোধে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর আশ্বাসবাণী শোনানো হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।
ডিজিটাল আইন নিয়ে দেশী-বিদেশী চাপের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমের লাগাম টানার নামে আরেকটি নিবর্তনমূলক আইন করার পথে হাঁটছে সরকার। নাম দেয়া হয়েছে ‘ডাটা প্রোটেকশন আইন’। পাশাপাশি বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে দেশের সীমানার বাইরে থেকে যারা নানা ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন তাদের ধরার আয়োজন চলছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
একটি করপোরেট মিডিয়া হাউজের দু’টি জাতীয় দৈনিকে প্রায় অভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশ থেকে গুজব ও অপপ্রচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই উদ্দেশ্যে ইউটিউব, ফেসবুকের অফিস ও সার্ভার ঢাকায় আনতে বাধ্য করতে চায় সরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটর করতে না পারলে সরকার ও সমাজে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলেও যুক্তি দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে। উদাহরণ হিসেবে ভারত, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব-আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথিত ‘অপকর্ম’ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
নতুন আইন ও সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আরো বলা হয়েছে, গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা সৃষ্টি বা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউব। অ্যাকাউন্ট বাড়ছে টুইটার, ইনসটাগ্রাম, লিঙ্কডইন, টিকটক, লাইকি, বিগো লাইভের মতো প্ল্যাটফরমগুলোয়। আর এসব মাধ্যম ব্যবহার করে নারী পাচার, মাদক বিক্রি, উগ্র মৌলবাদ, অপপ্রচারের মাধ্যমে সমাজে ও রাষ্ট্রে সহিংসতা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়া, দেশ ও সরকারবিরোধী প্রচারণা, ব্যক্তি বা নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও আপলোড করে নারীর সম্মানহানি, নগ্নতা থেকে শুরু করে নানা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ বেড়ে চলেছে বলে দাবি করা হয়।
আপাতদৃষ্টিতে উল্লিখিত অপরাধ বৃদ্ধি ও তা প্রতিরোধে নতুন আইন দেশ ও জনগণের জন্য হিতকর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আবার বর্ণিত অপরাধ দমনে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সিকিউরিটি আইন ছাড়াও ফৌজদারি আইনে যথেষ্ট বিধি-বিধান বিদ্যমান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের সময়ও উল্লেখিত অপরাধগুলো সামনে আনা হয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এখন নতুন আইনের প্রয়োজন পড়ছে কেন? এ প্রশ্নের খানিকটা উত্তর মিলবে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ডিজিটালাইজেশনের অপব্যবহার করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চক্র সরকারবিরোধী অপপ্রচার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। বিভিন্ন দেশে বসে একটি ইস্যু তুলে সেটিকে বুস্ট করে ভাইরাল করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের সুযোগ নেই। তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও সামাজিকমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে আইন আছে। এসব আইন পর্যালোচনা করে আমরা ডাটা প্রটেকশন আইনের খসড়া তৈরি করছি। যাচাই-বাছাই শেষে আইনটি নিয়মানুযায়ী অনুমোদনের জন্য দেয়া হবে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যমগুলো যাতে বাংলাদেশে তাদের সার্ভার ডাটা সেন্টার স্থাপন করে, আইনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করা হবে। তখন এসব প্ল্যাটফরমে অপপ্রচারকারীদেরও বিচারের আওতায় আনা সহজ হবে।
আর মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার নতুন আইনের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা ফেসবুক ও ইউটিউবের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে তাদের অফিস করার জন্য বারবার বলেছি। তারা শোনেনি। এখানে অফিস থাকলে বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে তাদেরকে ধরতে পারতাম। অপরাধীকে না পেলেও সংশ্লিষ্ট সামাজিক মাধ্যমটিকে পেতাম। এখন আপত্তিকর বিষয়বস্তু মনিটর করতে তারা কিছু স্থানীয় প্রতিনিধি রেখেছে, তারাও ঠিকভাবে কাজ করে না। তবে আগে আমরা অভিযোগ করলে এক শতাংশ কনটেন্টও মুছত না, এখন ২০-২৫ ভাগ কন্টেন্ট মুছে দিচ্ছে। বাকিগুলো কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের অজুহাত দেখিয়ে রেখে দেয়। এ জন্য সামাজিকমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে অন্য দেশগুলোর মতো কঠোর আইন করতে বলেছি। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যরা আইন করে এসব অপরাধের জন্য জরিমানা করছে। আমাদেরকেও আইন করে তাদেরকে অফিস স্থাপনে বাধ্য করতে হবে। আমাদের কথা শুনতে বাধ্য করতে হবে। এক কথায় বললে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল বাঁকা করতে হবে।’
এ দিকে বিদেশে বসে যারা কথিত ‘রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারে’ লিপ্ত, তাদের বিচারের আওতায় এনে শায়েস্তা করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশোধিত আইনের ৩ নম্বর ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি বিদেশে বসে দেশের কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতির সাহায্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটান, তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইন এমনভাবে প্রয়োগ হবে যেন অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের ভেতরেই সঙ্ঘটিত হয়েছে।
পত্রিকার প্রতিবেদন ও মন্ত্রীদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফাঁক-ফোকর গলে মতপ্রকাশের যেটুকু সুযোগ অবশিষ্ট আছে তা বন্ধ করাই নতুন আইনের লক্ষ্য। সামাজিক মাধ্যমে কর্তাব্যক্তিদের ছিটেফোঁটা সমালোচনাও আর সহ্য করতে চায় না সরকার। মামলা, হামলা, নিপীড়নের মুখে নির্বাসিত জীবনে গিয়ে দেশের সীমানার বাইরে থেকে যারা অন্যায়, অবিচার, অনাচার, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাদেরকে কিভাবে উচিত শিক্ষা দেয়া যায় তা নিয়েই এই নতুন আইনের তোড়জোড়।
আরেকটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার সাথে নতুন আইনের সম্পর্ক নিবিড়। ২০১৮ সালেও জাতীয় নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে তড়িঘড়ি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়। অর্থাৎ নতুন আইনের মোড়কে দেশ, জনগণ, বা সাইবার বুলিং-এর শিকার ভুক্তভোগীর সুরক্ষার কথা বলা হলেও ভেতরে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার আরেকটি কালাকানুনের পথে হাঁটছে সরকার। এবার এমন এক সময়ে সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশকে পুরোপুরি স্তব্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে যখন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সর্ববৃহৎ ও প্রভাবশালী সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) বাংলাদেশের সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে। ৫ জুলাই প্রকাশিত ‘প্রেস ফ্রিডম প্রিডেটরস’ ইনডেক্স প্রকাশ করে তারা। এতে বাংলাদেশ সরকারকে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক শিকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। বহুল প্রচারিত পত্রিকার একজন সম্পাদক ধারাবাহিক নিবন্ধে যখন সরকার প্রধানকে ‘গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুহৃদ’ হিসেবে আলোকিত করার প্রয়াস পেয়েছেন তার এক সপ্তাহের মধ্যেই এলো এমন প্রতিবেদন। সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
আরএসএফ গত এক বছরে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার, নিপীড়নের চিত্র সামনে এনেছে। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার প্রসঙ্গ টেনেছে। শুধু আরএসএফ নয়, গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্টেও সংবাদমাধ্যম ও ভিন্নমত দলনের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেফতার নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তাও উদ্বেগজনক। যেসব দেশের উদাহরণ টেনে নতুন আইন করার যুক্তি দেখানো হচ্ছে- সেসব দেশে কি আইনের যথাযথ প্রয়োগের চেয়ে যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের উদাহরণ মিলবে? উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর বা সৌদি-আমিরাত যদি আমাদের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মডেল হয়, তাহলে ওই সব দেশের জনসাধারণের উন্নত জীবনমান কেন মডেল হবে না। যাদের আইন সংগ্রহ করলেন তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, করোনার মহাদুর্যোগে প্রতিটি নাগরিকের ঘরে না চাইতেই প্রয়োজনীয় অর্থ ও খাদ্যের সংস্থান, স্বল্প সময়ে সবার জন্য টিকার বন্দোবস্তের বিষয়টি কেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে?
সভ্য দুনিয়ায় মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারকে সর্বাগ্রে সমীহ করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুলোধুনো করেও আক্রান্ত হওয়া তো দূরের কথা তেমন কোনো চাপও সামলাতে হয়নি সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ মার্কিন মিডিয়াকে। আমাদের মন্ত্রী যখন সামাজিক মাধ্যমের ২৫ শতাংশ অপছন্দের কনটেন্ট মোছাতে বাধ্য করার সাফল্য জাহির করেন তখন ট্রাম্পের বিতর্কিত ফেসবুক ও টুইটার পোস্ট মুছে দেয়ার খবর বিশ্ববাসীর জানা। সেখানে ক্ষমতার দাপটে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া যায়নি। কারণ সেখানে সরকার বা সরকার প্রধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। আইন চলে নিজস্ব গতিতে। শাসকশ্রেণীর ব্যক্তিগত ও দলীয় আক্রোশ চরিতার্থ করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের বড় সৌন্দর্য।
লেখক : সাংবাদিক, সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)
Discussion about this post