– হাসান রূহী
||১||
অন্ধকারে গাড়ির ভেতরেই পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয় এক গৃহবধূকে। এ সময় বেঁধে রাখা হয় তার স্বামীকে। নিজেকে রক্ষা করতে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিল গৃহবধূ। স্বামীও চিৎকার করছিলেন। এ সময় উল্লাস করছিল ছাত্রলীগ কর্মীরা। চিৎকারের আওয়াজ রোধ করতে তারাও করে চিৎকার। চিৎকার শুনলেও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে- তারা ফোন করে ঘটনা জানায় শাহপরান থানা পুলিশকে। পুলিশ আসতে আসতেই গণধর্ষণের শিকার হয় ওই বধূ। রাত ৯টার দিকে যখন পুলিশ এমসি কলেজের হোস্টেলে পৌঁছায় ততক্ষণে ধর্ষকরা সটকে পড়ে। হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন স্বামী-স্ত্রী। গণধর্ষণের কারণে স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে স্বামী কাঁদছিলেন। পুলিশকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। এরপর পুলিশ তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে এক নারীকে ধর্ষণের এমন রোমহর্ষক বর্ণনা ছেপেছে আজ দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকা। এ খবর পড়ার পর থেকে যারা মানুষ নিশ্চয়ই তারা ঘৃনায় আর ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। হয়তো তারা কণ্ঠ উচ্চকিত না করে নিন্দাও করছেন। মনে মনে এসব গুন্ডাদের উপযুক্ত শাস্তিও কামনা করছেন। কিন্তু কণ্ঠ উচ্চকিত করার সাহস বোধকরি কারও নেই। তাহলে হয়তো উল্টো তাকেই ভিপি নূরের মত ধর্ষণের মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে।
দেশজুড়ে জুলুমের সয়লাব হয়ে গেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ এর পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টালে একাধিক ধর্ষণের খবর আপনার নজর কাড়বে। এমসি কলেজের বর্বরোচিত ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি আরও অন্তত দু’টি ধর্ষণের খবর আমার চোখে পড়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর খবর- ‘মা-বাবাকে বেঁধে পাহাড়ি তরুণীকে ধর্ষণ, আটক ৭’। দৈনিক মানবজমিনের খবর – ‘মুমূর্ষু স্বামীর জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার স্ত্রী, গ্রেফতার ২’।
প্রতিদিনের পত্রিকা খুললে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গুন্ডাপান্ডাদের গুন্ডামির খবর আপনার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করবে। বিরক্ত, অতিষ্ট, ক্রুদ্ধ এমনকি আতঙ্কিত হবেন। কিন্তু সবার মধ্যে কেমন যেন এক অদ্ভূতরকম নীরবতা। নিশ্চল, নিথর, উপায়হীন সবাই। তারচেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হলো কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে তৈলমিশ্রিত প্রতিবাদ করছেন। তারা সরকার কিংবা এই ধর্ষক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাকে ইনিয়ে বিনিয়ে দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন।
||২||
আপনি জানেন কি? আপনার এই নীরবতা, অক্ষমতা কিংবা তৈলমিশ্রিত প্রতিবাদ ওদেরকে একদিন মন্ত্রী বানিয়ে দেবে! কি! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে চলুন একটু ইতিহাস থেকে ঘুরে আসি।
১৯৭৪ সাল। তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্র। যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশের অবস্থা যতটা নাজুক থাকতে পারে, দেশের ও জনগণের অবস্থা একদম ঠিক তাই। দেশের সর্বময় ক্ষমতা তখন শেখ সাহেবের হাতে। তার কথাই আইন, তার কথাই বিচার। এখন যেমন হাজারও অন্যায় অত্যাচার দেখার পরেও কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ সাহস করে মুখ খুলতে তার অবস্থা হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মত। ঠিক তখনও কারও মুখে কোনো রা শব্দটি নেই। তেমনই এক সময়ে এক নবদম্পতি গাড়ীতে করে যাচ্ছিল গাজিপুর থেকে ঢাকার দিকে। স্বভাবতই চাঁদা কিংবা কে যায় দেখার জন্য গাড়ি থামায় জনৈক মোজাম্মেল। এই থামানোর অধিকার মোজাম্মেলের আছে। কারণ তিনি শেখ মুজিবের লোক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ বানিয়েছেন। গাড়ি থামিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানে নতুন বউ। মেয়েটিকে দেখে পছন্দ হয় স্বয়ং মোজাম্মেলের!
তারপরের কাহিনী নিয়মিত ঘটনার মতোই। টঙ্গীর আওয়ামীলীগ নেতা ও দেশপ্রেমিক মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়িটি আটক করে। ড্রাইভার আর নববধূর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে, অতঃপর তিনদিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় টঙ্গী ব্রিজের নিচে।
পৈশাচিক এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় সর্বত্র। বিশেষ অভিযানে দায়িত্বরত মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ে। মোজাম্মেল মেজরকে বলে- ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন, আপনাকে তিন লাখ টাকা দেবো। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাবো। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না। মেজর নাসের হুঙ্কার ছাড়লেন, এটা তুচ্ছ বিষয়? আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করবো। তোমার তিনলাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।
এরপরের কাহিনী অতি সরল। কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোজাম্মেলের বাবা, দুই ভাই গেল শেখ সাহেবের কাছে। তিনি ঢোকা মাত্র মোজাম্মেল এর বাবা ও দুই ভাই কেঁদে তার পায়ে পড়লো। টঙ্গী আওয়ামী লীগ এর সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে পেলেন না। শেখ সাহেবের পা তখন মোজাম্মেল এর আত্মীয় স্বজনের দখলে।
শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি? টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের সোনার ছেলে মোজাম্মেলকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মেজর নাসির তাকে ধরে নিয়ে গেছে। বলেছে তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে। কাঁদতে কাঁদতে আরো বললো, এই মেজর আওয়ামী লীগের নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, টঙ্গীতে আমি আওয়ামী লীগের কোন শূয়োর রাখবো না। বঙ্গবন্ধু, আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির! টঙ্গীতে থাকি না। ঢাকায় চলে আসছি। (ক্রন্দন)
এবার হুঙ্কার ছাড়লেন মুজিব, কান্দিস না। কান্দার মত কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বাইচ্যা আছি তো, মইরা তো যাই নাই। এখনি ব্যবস্থা নিতাছি। অতঃপর মোজাম্মেলকে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মেজর নাসেরকে টঙ্গী থেকে সরিয়ে দেয়ার জরুরী আদেশ দেওয়া হলো। মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রন করেছিল।
(সূত্র: Bangladesh Legacy of Blood, Anthony Mascarenhass, দেয়াল, হুমায়ুন আহমেদ।)
ইতিহাসের সেই মোজাম্মেল কালের পরিক্রমায় এখন মন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের হোলসেলার। দেশপ্রেমিকদের প্রতিনিধি!
||৩||
এমসি কলেজ হোস্টেলে গণধর্ষণের ঘটনার পর একদল কথিত গবেষক, বিশ্লেষক, সাংবাদিক টেলিভিশন টকশো’র টেবিলে গলা উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগের বর্তমান প্রজন্ম নাকি তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অপমান করছে। কোনো কোনো কলামিস্টও পত্রিকার পাতায় এমনটা লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটি আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। এই একই কথা তারা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রতিটি চাঞ্চল্যকর অপরাধ সংঘটনের পর নিয়ম করেই বলেন। আর এটিই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ঐতিহ্য।
যারা এমনটা বলেন ও লেখেন তারা না জানে আওয়ামী লীগকে। না জানে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য। আবার এমসি কলেজের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু নালায়েকের দেখা মিলছে ভাবখানা দেখে মনে হয় তারা এতদিন এই দেশে ছিল না। এমন কোথাও ছিল যেখানে মিডিয়া ইন্টারনেট কিছুই ছিল না। এমসি কলেজের ধর্ষকদের তারা বিচার চান, কারণ তারা নাকি শেখ সাহেবের হাতে গড়া সংগঠনের মান ক্ষুন্ন করেছে! এরা জানেই না খোদ শেখ সাহেব নিজ দলের ধর্ষককে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়ার পর আজকে সেই খুনী ধর্ষক এই দেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা যেন ভুলে গেছে এই সংগঠনের নেতারা ধর্ষণে সেঞ্চুরি উদযাপন করার পরও বিচারের মুখোমুখি না হয়ে উল্টো পুরস্কৃত হয়েছে! ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা দখলের পর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় এক নারীকে গণধর্ষণ করে নির্বাচনী বিজয় উৎসব করেছে! কওমী জননীর আশির্বাদে মাত্র চার মাস পর ধর্ষক রুহুল আমীনকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
যারা প্রতিবাদ করছেন ভালো কথা। প্রতিবাদের সাথে দয়া করে তৈল মিশ্রণ করবেন না। আপনার প্রয়োগকৃত এই তৈল তাদের মন্ত্রী হওয়ার পথ সহজ করে। আর নীরবতা, অক্ষমতাও তাদেরকে অপকর্মে দ্বিগুণ উৎসাহ জোগায়। তাই প্রতিবাদ করুন। এবং জেনে শুনে চিন্তা করেই প্রতিবাদ করুন। প্রতিবাদ করুন প্রতিটি অন্যায়ের। ইতিহাসকে সামনে রেখে ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে সক্রিয় হোন। অন্যথায় ডায়েরীতে লিখে রাখুন- এই ধর্ষকরাই একদিন মন্ত্রী হবে। ঠিক এভাবেই দেশ চালাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট