অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সম্প্রতি অতি শক্তিশালী সাইক্লোন আম্পান বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে আঘাত হানার পর দুদিন পার হয়ে গেলেও এখনো দক্ষিণাঞ্চলের অনেক গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর, এবং কৃষিজমি ও চিংড়ি ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুর্গত মানুষদের কাছে কিছু কিছু ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, এবং ভেঙে পড়া বাঁধগুলো এখন পর্যন্ত মেরামত না হওয়ায় এখনো বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে। এই চিত্র শুধু এবারের নয় ঘুর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এই উপকূল এলাকার রোজকার দিন এভাবে চলে। দীর্ঘ এগারো বছর অতিক্রম হলেও নেই কোন শক্ত বাঁধের ব্যবস্থা। আইলা, নার্গীস, ফনি, বুলবুল, এভাবে একের পর এক ঝড়ে লন্ডভন্ড করে দিলেও সরকারিভাবে বাঁধের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধিরা বার বার আশ্বাস দিলেও কখনও বিশ্বাস মেলেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে উপকূলবাসীকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কেন এই তামাশা? স্থানীয় প্রতিনিধিরা কি আসলেই বাঁধের সংস্কার চান?
পানিতে তলিয়ে গেছে মাইলের পর মাইল জনপদ। গৃহহারা হয়েছেন লাখ মানুষ। আর একরের পর একর ফসলি জমি পরিণত হয়েছে কুলকিনারাহীন নদীতে। সাইক্লোন আম্পানের তাণ্ডবের পর এমন অবস্থায় পড়ে রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনার উপকূলীয় এলাকা। দেখা গেছে দেশের ২৬ জেলায় এই পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ও বরগুনা। গত ২২ মে হেলিকপ্টারে আকাশ থেকে আম্পান দুর্গত এলাকা দেখে, ভাসানচরে নামলেন মন্ত্রীরা। তবে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে বললেন, আম্পানে একটি ঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। জীবনযাত্রা রয়েছে স্বাভাবিক।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানাধীন গাবুরা ইউনিয়ন। নদীবেষ্টিত ইউনিয়নটিতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয়ের পর উঠে দাঁড়াতে পারেনি এই দ্বীপের মানুষ। সেই ক্ষতে বারবার আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড়। মাত্র ছ’মাস আগে বুলবুল, এক বছর আগে ফণীর গতি ছিলো এদিকেই। একই পথে ঘূর্ণিঝড় আম্পানও সবাইকে নিস্ব করে দিয়ে গেলো। এভাবে যখন একের পর এক মানুষ নিজের শেষ সম্বলও হারাতে বসেছেন ঠিক তখন ত্রাণ বিতরণের আড়ালে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
স্থানীয় প্রতিনিধিরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ
দুর্যোগ আসলেই দেখা যায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রতিনিধিদের পকেট ভারি হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে আইলার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান শফিউল আযম লেনিন রাতারাতি কটিপতি বনে যান। আসহায় মানুষের টাকায় নিজস্ব থানা শহর শ্যামনগরে গড়ে তুলেছেন ডু প্লেক্স বাড়িও। শুধু লেনিন নয় লেনিনের এই রশি ধরে লাখপতিও হয়েছেন বহু নেতা। সরকারিভাবে কোন অনুদান আসলেই স্থানীয় প্রতিনিধিরা ভাগাভাগি করে যে ছিটেফোটা থাকতো তাই জনগণের মাঝে বন্টন করা হতো। এছাড়া কোন এনজিও সহায়তার জন্য গেলেও বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় এসব আওয়ামী প্রতিনিধিরা। শুধু তাই নয় স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেই তাদের নামে দেওয়া হয় খুন ডাকাতির মামলা। এরপর ভোট ডাকাতির নির্বাচনে চেয়ারম্যান হয় আওয়ামী লীগ নেতা লেনিনের ছোট ভাই গোলাম আযম টিটু। বড় ভাইয়ের ছিলছালাই তিনিও পিছিয়ে থাকেননি। মামলার হুমকি দিয়ে মৎস ঘেরের পানি ওঠানো গেট মালিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন লক্ষ লক্ষ টাকা। এরপর তার মৃত্যুতে এলাকার মানুষ স্বস্থি ফিরে পেলেও লেনিনের ইন্ধনে স্থানীয় আওয়ামী নেতারা এসব লুটের রাজত্ব চালিয়ে যেতে থাকে।
সূত্র বলছে, বাঁধ হলে স্থানীয় প্রতিনিধি ত্রাণ লুট বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য তারা নানা অযুহাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় আওয়ামী নেতাদের সাথে মতের বিরোধ দেখা দিলেই হামলার হুমকি দেওয়া হয়। মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয় সাধারণ মানুষদের। ফলে এলাকার বাসিন্দারা কোন প্রতিবাদ করতে পারেনা। সূত্রের দাবি, বর্তমানে চেয়ানম্যান মাছুদুল আলম এলাকাবাসীকে নিয়ে কাজ করার স্বদিচ্ছা থাকলেও আওয়ামী ইউপি সদস্যদের খামখেয়ালিপনায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।
স্থানীরা বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের এমন আচরণই বাঁধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। বাঁধ হলে এসব নেতারা লুট করতে পারবে না এজন্যই তারা চাননা যে বাঁধ হোক। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি বাগদা চিংড়ির চাষ হয়- এই গাবুরায়। প্রচুর চিংড়ি এখানে উৎপাদন হয়। প্রতিবারই ঘেরগুলা নদীতে ভেসে যায়, ত্রাণের নামে নেতার পকেট ভরে তাই তাদের একটাই দাবি ত্রাণ নয় একটি শক্ত বাঁধ চাই। যাতে মানুষকে বারবার দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।
ফাঁকা বুলিই তাদের সান্তনা
এই দ্বীপে ফণী ও বুলবুলের পর দু’-দু’বার মন্ত্রী এসেছেন, সচিব এসেছেন। অনেক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। যেটুকু হয়েছে মেরামত বা জোড়াতালি। শুধু গাবুরা নয় ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয়ের পর উঠে দাঁড়াতে পারেনি দেশের পশ্চিম উপকূল। সেই ক্ষতে বারবার আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড়। মাত্র ছ’মাস আগে বুলবুলের গতি ছিলো এদিকেই। একই পথে ঘূর্ণিঝড় আম্পানও সবাইকে নিস্ব করে দিয়ে গেলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে এই অঞ্চলে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তার বয়স প্রায় ২০ বছর। এরপর সরকারি উদ্যোগে নতুন কোন বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। কোন প্রকার দুর্যোগ দেখা দিলে এলাকার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রম ও কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় বাঁধ মেরামত করা হয়। যা টেকসই হয় না বরং পর্বর্তিতে আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। সরকার বলছে, বাঁধের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই নিজ উদ্যোগে নির্মান করতে হবে বাঁধ। কিন্তু বাস্তবতা দেখা যায়, এত দিন পর্যন্ত ভুক্তভোগীরা নিজ শ্রম দিয়ে ক্ষণিক সংস্কার করলেও প্রতিবছরই স্বীকার হচ্ছে বন্যায়। হাজার হাজার মানুষ হারাচ্ছে বসতভিটা।
সুন্দরবন লাগোয়া তিনটি উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার প্রান্তিকের বহু জনপদ দুর্যোগের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। একবার দুর্যোগ এলে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগে যুগের পর যুগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ থাকে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণ পানি যেসব এলাকা ভাসিয়েছে; সেখানে আর ফসল হচ্ছে না। সবুজ শূন্য হয়েছে অনেক জনপদ। পেশা বদলে গেছে সেই জনপদের বাসিন্দাদের। সুপেয় খাবার পানির সংকট তীব্র হয়েছে। তাই এসব উপকূলবাসীর দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, সুপেয় পানি আর বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট সংস্কার।
‘ত্রাণ চাই না, বাধঁ চাই’
বহুদিন ধরে এসব উপকূলবাসীর একটি টেকসই বাঁধের দাবি করে আসলেও ক্ষমতাসীনদের খামখেয়ালিপনায় এখনও সম্ভব হয়নি। এবার সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতের পর সেই দাবি জোরেসরে উঠেছে। স্লোগান তুলেছেন দাবি মোদের একটাই টেকসই বাঁধ চাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন। দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই এই দাবির পক্ষে সাড়া দিয়েছেন। স্থানীরা বলেছেন, ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি তাদের জীবন জীবিকাও এখনও বড়ধরনের হুমকির মুখে। তারা জানেন না কীভাবে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবেন।
সেখানকার মানুষের একটাই দাবি এখন- ‘আমরা ত্রাণ চাই না, আমরা একটা নিরাপদ আর শক্ত বেড়িবাঁধ চাই। যাতে মানুষকে বারবার দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। স্থানীয় নেতারাও যেন আমাদের জিম্মি করে রাখতে না পারে।’
বিবিসির সাক্ষাৎকারে গাবুরা ইউনিয়নের একজন স্বেচ্ছাসেবক মানিক হোসেন বলছেন ঝড়ের দিন অনেকে এমনকী অনেক কর্মকর্তাও তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন, কিন্তু ঝড় থেমে যাবার পর কেউ তাদের খোঁজও নেয়নি। “আমাদের গাবুরার লেবুগুনি নামে একটা গ্রাম আছে, ওখানে জোয়ারের পানিতে অনেকখানি রাস্তা ভেঙে পুরা তিনটা গ্রাম তলায় গ্যাসে। এখনও সেখানে বাঁধ দেয়া সম্ভব হয়নি, এখনও সেইভাবে রয়েসে। আইলায় একবার (গ্রামগুলো) ডুবে গ্যাসে, সিডরে ডুবে গ্যাসে, আম্পানে আবার ডুবে গেল, এজন্য মানুষ চায় শক্ত একটা বেড়িবাঁধ।”
তারা বলছেন, উপকূল রক্ষী বাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে যে সকল ত্রাণ আসে তার সঠিক বন্টন হয়। কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় যে ত্রাণ দিচ্ছে মানুষ এখনও ত্রাণ পাচ্ছেনা। এলাকার বেশিরভাগ মানুষই দুর্ভোগে আছে। কিছু সাহায্য আসলেও সেগুলো ঠিকমত বন্টন হচ্ছে না।