অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা যখন একদিনেই সর্বচ্চ ঠিক তখন সেরে ওঠার সংখ্যা ১৭৭ থেকে একলাফে ১ হাজার ৬৩ জনে দাঁড়িয়েছে। রোববার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধিদফতরটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, এখন পর্যন্ত এক হাজার ৬৩ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
তবে কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি রোগী সুস্থ হলো তা নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। আবারও প্রশ্ন উঠেছে সরকারে তথ্য গোপনীয়তা নিয়ে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রাণঘাতী নোভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) অন্যান্য দেশের মতো সংকটময় অবস্থায় বাংলাদেশও। গত ২৩ এপ্রিল করোনায় বাংলাদেশের সুস্থতার হার মাত্র ২%। যেখানে বিশ্বে সুস্থতার হার ২৭%,। এই সুস্থতার হার দক্ষিণ এশিয়া ও ভাইরাসটিতে সর্বাধিক আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ১৮ হাজার ৯৮৫ আক্রান্তের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে ৩ হাজার ২৭৩ জন। দেশটিতে সুস্থতার হার ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। পাকিস্তানে সুস্থতার হার আরও বেশি ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। দেশটিতে ৯ হাজার ৫৬৫ আক্রান্তের মধ্যে ২ হাজার ৭৩ জন সুস্থ হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়ার্ল্ডোমিটারের এই তথ্য প্রকাশের পর থেকে ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন বাহানায় সুস্থতার হার বাড়ানোর চেষ্টা করে চলছে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে প্রশংসা পেতে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী শুরু থেকেই তথ্য গোপন করে আসছে। এই তথ্য গোপনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে তারা। প্রথমে করোনার প্রেস ব্রিফিং বন্ধ করে দেওয়া হলো। সাংবাদিকরা করোনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন করত। যার উত্তর দিতে আইইডিসিআর এর কর্মকর্তাদের রীতিমতো হিমসিম খেতে হচ্ছিল। তাই তারা প্রেস ব্রিফিং এ সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো সাজানো গুছানো কিছু কথা বলে ব্রিফিং শেষ করছে।
যদিও আইইডিসিয়ার বলছে , কাদেরকে সুস্থ বলা হবে সে ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া একটি নতুন গাইডলাইন অনুসরণ করছেন তারা। কোন কোন হাসপাতাল থেকে কতজন কোভিড রোগী সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছেন তার বিবরণও তুলে ধরা হয় ব্রিফিংয়ে।
এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬৬৫ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪৫৫ জনে। এই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ জন। এ নিয়ে দেশে কোভিড-১৯ এ মৃতের সংখ্যা ১৭৭। যদিও গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।
তথ্য জানানো হচ্ছেনা সাংবাদিকদের
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এভাবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য জানার সুযোগ সীমিত করছে। সাংবাদিকেরা কোনো তথ্য খতিয়ে দেখলেই এমনটা হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে এপ্রিলের গোড়া থেকে, যখন কিনা প্রতিদিন দেশে শনাক্ত হওয়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
প্রথমে বন্ধ হলো রোজকার ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ। তারপর বাদ পড়ল মজুত থাকা শনাক্তকরণ কিটের তথ্য। তারও পরে ছাঁটাই হলো কেন্দ্রভিত্তিক নমুনা পরীক্ষার দৈনিক হিসাব। অধিদপ্তর তথ্য দেয় সংক্ষেপে। বিফ্রিংয়ে প্রশ্ন করে সাংবাদিকেরা বিশদ তথ্য আর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চাইতেন। প্রশ্নোত্তর বন্ধ হওয়ায় সে সুযোগ নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক সহ-উপাচার্য রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তথ্য সরবরাহে ধারাবাহিকতা না থাকলে বিভ্রান্তি হয়। তথ্যে মানুষের আস্থা হয় না, ভয়ভীতি কাটে না। সঠিক তথ্য স্বচ্ছ রীতিতে জানালে মানুষ আশ্বস্ত হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং শুরু করে। তথ্য উপস্থাপন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা।
সংক্রমণের আশঙ্কায় ২৩ মার্চ থেকে অনলাইনে ব্রিফিং হচ্ছে। ৬ এপ্রিল পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে নতুন ২৯ জনের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছে ৪ জন। আর মীরজাদী সেব্রিনার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংখ্যাগুলো ছিল ভিন্ন। সাংবাদিকেরা জানতে চান, কার তথ্য সঠিক।
৭ এপ্রিল থেকে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ হয়। ব্রিফিংয়ের নাম হয় ‘দৈনন্দিন স্বাস্থ্য বুলেটিন’। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির আদলে করা বুলেটিনের ছকে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য থাকে।
এগুলোর মধ্যে আছে, প্রতিদিন পরীক্ষা, আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। আছে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা, ‘লজিস্টিক’ মজুত ও সরবরাহ আর কোয়ারেন্টিন ও বিচ্ছিন্নকরণ-সংক্রান্ত তথ্য। আরও আছে বিদেশ প্রত্যাগতদের স্ক্রিনিং এবং মোবাইল ফোনে সেবাদানের তথ্য।
লজিস্টিক-এর ঘরে আগে শনাক্তকরণ কিটের রোজকার হিসাব থাকত। এখন শুধু পিপিইর মজুত ও বিতরণের তথ্য থাকে। ১১ এপ্রিলের পর থেকে অধিদপ্তর কিটের কোনো হিসাব দিচ্ছে না।
টানা ১৪-১৫ দিন হালনাগাদ তথ্য না পেয়ে সাংবাদিকেরা বিষয়টি নিয়ে লেখেন। তারপর ২৬ এপ্রিল বুলেটিন প্রকাশের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, কিটের কোনো সংকট নেই। মজুত পর্যাপ্ত। তবে তিনি সংখ্যাটা বলেননি।
দেশে এখন ২৭টি ল্যাবরেটরিতে শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। দিনে মোট কমবেশি ৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু এযাবৎ সর্বোচ্চ হয়েছে ৪ হাজার ৩৩২টি।
অধিদপ্তরের বুলেটিনে কেন্দ্রভিত্তিক দৈনিক নমুনা পরীক্ষার হিসাব থাকত। তারপর সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন বেরোয় যে কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা অনেকটাই ব্যবহৃত হচ্ছে না। ২৪ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রভিত্তিক তথ্য উধাও হয়ে গেছে। শুধু দুই ভাগে ঢাকার বাইরে ও ঢাকার ভেতরের হিসাব দেওয়া হচ্ছে।
আতঙ্ক ঠেকাতে তথ্য গোপন
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও যে বাড়তে থাকবে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়াবে? এবং কোন পর্যায়ে এসে এই হার কমতে শুরু করবে? এসম্পর্কিত একটি মডেল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট – আইইডিসিআর-এর হাতে রয়েছে।
কিন্তু জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে সেই বিবেচনায় এই মডেলটি সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ করছেনা।
বিবিসির সাক্ষাৎকারে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘করোনাভাইরাস রোগীদের কাছ থেকে নমুনা-রস সংগ্রহের কাজে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। একদিন নমুনা সংগ্রহ করে আরেকদিন তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেই তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে অন্য এক দিন। ফলে এর থেকে এখনই কোন সুনির্দিষ্ট মডেল তৈরি করা কঠিন। জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে সেই বিবেচনায় আইইডিসিআর এর হাতে তথ্য থাকলেও প্রকাশ করছেনা’
দেশের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর হার নিয়ে গত ২৬শে মার্চে তৈরি জাতিসংঘের একটি ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল রিপোর্ট বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এতে পূর্বাভাস করা হয়, বাংলাদেশে জনঘনত্বের বিবেচনায় করোনাভাইরাসে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটতে পারে।
তথ্য সূত্র: বিবিসি, প্রথম আলো