অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
প্রাণঘাতী করোনয়া বেড়েই চলছে আক্রান্তের সংখ্যা তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। আইইডিসিআরে এর তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা দেড় শতাধিক অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছুঁই ছুঁই। যদিও পত্রিকার খবর অনুযায়ী সরাদেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে তিন শতাধিক মানুষের। দেশের এই পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। দেশর মানুষ যখন আতঙ্কগ্রস্ত তখনও তথ্য গোপন করছে সরকার।
এখন প্রশ্ন উঠেছে দেশের এই ক্রান্তিকালেও কেন এই তথ্য গোপনের চেষ্টা?
বিশ্লেষকরা বলছেন করোনাভাইরাস সংকট দেখা দেয়ার পর থেকেই লকডাউন কার্যকর, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা, ভাইরাস টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন, গার্মেন্টস কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখা – এমন বেশ কিছু বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা জনমনে ভীতি তৈরী করেছে। এছাড়া রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। নিজেদের এসব দুর্বলতা ঢাকতে তথ্য গোপন করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা ফেঁসে যাচ্ছেন।
কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সামনে?
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও যে বাড়তে থাকবে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়াবে? এবং কোন পর্যায়ে এসে এই হার কমতে শুরু করবে? এসম্পর্কিত একটি মডেল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট – আইইডিসিআর-এর হাতে রয়েছে।
কিন্তু জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে সেই বিবেচনায় এই মডেলটি সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ করছেনা।
বিবিসির সাক্ষাৎকারে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন ‘করোনাভাইরাস রোগীদের কাছ থেকে নমুনা-রস সংগ্রহের কাজে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। একদিন নমুনা সংগ্রহ করে আরেকদিন তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেই তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে অন্য এক দিন। ফলে এর থেকে এখনই কোন সুনির্দিষ্ট মডেল তৈরি করা কঠিন। জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে সেই বিবেচনায় আইইডিসিআর এর হাতে তথ্য থাকলেও প্রকাশ করছেনা’
দেশের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর হার নিয়ে গত ২৬শে মার্চে তৈরি জাতিসংঘের একটি ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল রিপোর্ট বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এতে পূর্বাভাস করা হয়, বাংলাদেশে জনঘনত্বের বিবেচনায় করোনাভাইরাসে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটতে পারে।
‘১৩ কোটি আক্রান্ত হতে পারে’
বাংলাদেশে সংক্রমণের বিস্তার এক্সপোনেনশিয়াল হচ্ছে কিনা তার চিত্রটি এখনও পরিষ্কার না। প্রথম দিকের বৃদ্ধি এক্সপোনেনশিয়াল বলে মনে হলেও কয়েকদিন দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
তবে সংক্রমণের বিস্তার নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর গবেষক ড. মলয় মৃধা ও রিনা রানী পাল , নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দীপক কে. মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক দু’জন গবেষক মিলে যে রিপোর্টটি তৈরি করেন তাতে বলা হয় ১৩ কোটি মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।
জাতিসংঘের নথির মতোই এই রিপোর্টে ধরে নেয়া হয়, এই হারে সংক্রমণ ঘটবে যদি এই ভাইরাস মোকাবেলায় ২৮শে মে’র মধ্যে একেবারেই কোন উদ্যোগ নেয়া না হয়।
তবে এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ বিবৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে এটি তাদের কোন গবেষণা নয়।
সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা
সরকারের ১৮টি মন্ত্রণালয়ের অফিস খোলার পর গত রোববার দিনশেষে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। সোমবার সেই অফিসগুলো বন্ধ থাকে। করোনাভাইরাস সংকট দেখা দেয়ার পর থেকেই লকডাউন কার্যকর, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা, ভাইরাস টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন, গার্মেন্টস কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখা – এমন বেশ কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
১৮টি মন্ত্রণালয় সীমিত পরিসরে খোলার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল কয়েকদিন আগে। সেই মন্ত্রণালয়গুলোতে রোববার সীমিত পরিসরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কাজ হওয়ার পর সেদিনই বিকেলে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয় বা অফিসগুলোই শুধু খোলা রাখা হবে। চিকিৎসকদের পিপিই বা সুরক্ষা পোশাক সব পর্যায়ের চিকিৎসককে দেয়া হবে কিনা – এনিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি পরিস্থিতির শুরু থেকেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। আর করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনও নানা আলোচনা রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থার সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা যাচ্ছে। আসলে পরিস্থিতিটা ক্লোজলি বোঝার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে গেছে মনে মনে করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের এখানে মনে হচ্ছে যেন, চিন্তা ভাবনা না করেই একেক সময় একেক ধরণের ভাবনা আসছে। কিংবা অনেক সময় অনেক জায়গা থেকে হয়তো চাপও আসে। সেকারণেও কিন্তু এধরণের সিদ্ধান্তহীনতাটা দেখা যায়।
‘রাজনৈতিক নেতা যারা আছেন, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর সাথে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগুলোর কোন যোগসূত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।এবং সেখানে সম্ভবত একটা ফারাক রয়ে গেছে।’
বিশ্লেষকরা বরছেন,সরকারের সিদ্ধান্ত আমলা নির্ভর হয়ে পড়ছে।
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব
ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট এ দুই দপ্তরের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে তীব্র। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শোনেন না মহাপরিচালকের কথা। আরেকজন পরিচালক নিম্নমানের সামগ্রী কেনাকাটায় ব্যস্ত। আবার মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো সিদ্ধান্তও জানানো হয় না মহাপরিচালককে।
এভাবে সমন্বয়হীনতার কারণে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সাসেবায় চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখনো পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছে চিকিত্সকদের জুনিয়র টিম। কোভিড-১৯ চিকিত্সার জন্য উচ্চতর বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের একটি টিম এখনো গঠিত হয়নি। চিকিত্সাসেবার ক্ষেত্রে নন-মেডিক্যাল পারসনদের মতামত এককভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। যার কাজ তাকে দিয়েই করানো উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা এমন দুরবস্থার কথা স্বীকার করে বলেন, চিকিত্সাসেবায় ডাক্তার, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ডাক্তারদের নিরাপত্তার কথা ভাবলে হবে না। হাসপাতালের সুইপারদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সমপরিমাণ সুরক্ষাসামগ্রী না থাকায় বাস্তবিক অর্থে রোগীরা পড়ে থাকে। তেমন কোনো চিকিত্সাসেবা পান না। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সময় পেয়েও সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন হয়নি। এর মধ্যে আছে আবার রাজনৈতিক মতপার্থক্য। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা টেন্ডারবাজি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এ কারণে ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে নিম্নমানের মাস্ক ও পিপিই। কয়েকটি হাসপাতালের পরিচালকেরা জানান, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালের পরিচালক, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও সিভিল সার্জনদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হওয়া উচিত। প্রতিদিন কোনো কোনো হাসপাতাল পরিচালক ৫ হাজার থেকে নিম্নে সহস্রাধিক রোগীর চিকিত্সাসেবার ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো উচিত। এতে কার কার কী সমস্যা আছে তার তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু কোনো বৈঠকই হচ্ছে না। কোভিড-১৯ চিকিত্সার জন্য ডেডিকেটেড রাজধানীর তিনটি হাসপাতাল—কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার অন্ত নেই।
অভিযোগ আছে, করোনা ভাইরাস শনাক্তে কিট ও পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্টের (পিপিই) মজুত নিয়ে সংকট বিরাজমান থাকার পরও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বারবারই বলেছেন, এসবের কোনো সংকট হবে না। পর্যাপ্ত মজুত আছে। তাই যদি হয়, তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিরাময় কেন্দ্র ১৭ ফেব্রুয়ারি কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ লাখ পিপিই, ৫ লাখ মাস্ক, সার্জিক্যাল গগলস ও অন্যান্য সরঞ্জাম চেয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছিল? অথচ এ বিষয়ে গড়িমসি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা, তা হলো পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সব দেশেরই উচিত সন্দেহজনক সব রোগীকে পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে থাকলে দেশগুলো এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না। পরীক্ষা ছাড়া সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা যাবে না, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। বিভিন্ন দেশই যে এই কাজে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা চালু করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিত্সার জন্য সারাদেশে ১২৬টি ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বরাবরই বলছেন, ৫০০ ভেন্টিলেটর রাখা হয়েছে। আরো ৩৫০টি ভেন্টিলেটর যুক্ত করা হবে। এ পরিস্থিতিকে ‘লেজে গোবরে অবস্থা’ আখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী এমন পরিস্থিতিতে ‘লিড’ দেবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। দেশের কোন হাসপাতালে কী ধরনের সুবিধা আছে, আরো কী প্রয়োজন—এর পুরোটা জানেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালকগণ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত মহাপরিচালক জানেনই না। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাকে জেনে নিতে হচ্ছে। এমন অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার।