সানাউল্লাহ সাকিব
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষত মোকাবিলায় সরকার ইতিমধ্যে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর পুরোটাই যাবে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ হিসেবে। প্যাকেজের কোনোটাই কোনো অনুদান নয়, ব্যাংকগুলো ভালো গ্রাহকদের বেছে বেছে এই ঋণ দেবে। ঋণের সুদের কিছু অংশ সরকার বহন করবে এবং বাকিটা ওই গ্রাহককে দিতে হবে। সরকার যে কিছু সুদ বহন করবে, এটাই এই প্রণোদনা প্যাকেজের মূল বৈশিষ্ট্য।
ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক ভালো, নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেছেন, মূলত তাঁরাই এ প্যাকেজ থেকে ঋণ পাবেন।
ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু ভালো গ্রাহক নন, এমন ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা পাবেন না। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি, এনজিও বা স্থানীয় পর্যায়ে অন্য মাধ্যম থেকে টাকা নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁরা সহজেই এ প্যাকেজের সুবিধা পাবেন না। কারণ, ব্যাংকের কাছে তাঁদের কোনো হিসাব নেই।
অর্থনীতিবিদেরাও বলছেন, যারা ঋণখেলাপি, ব্যাংক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, যারা ঋণ পুনঃ তফসিল বা পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েছে, তারা কোনোভাবেই যেন এসব প্রণোদনা প্যাকেজের সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আর ব্যাংকাররা বলছেন, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিচার–বিশ্লেষণ করে ঋণ দেওয়া হবে। কারণ, ব্যাংকগুলোকে সরকার তো কোনো তহবিল দিচ্ছে না। তাই ফেরত পাওয়া যাবে, ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে, শুধু এমন গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া হবে। গ্রাহকেরা বিশ্বাস করে ব্যাংকে আমানত রাখেন, তা সুরক্ষিত করার দায়িত্ব ব্যাংকের।
কয়েকজন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার জানিয়েছেন, শ্রমিকদের বেতন দেওয়া ছাড়া খুব সহজেই এ প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ শুরু হবে না। কারণ, করোনায় কার কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা এখনো নির্ধারণ হয়নি। বর্তমান অচলাবস্থা কত দিন চলবে, তা–ও বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের পর ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে। সেটা অনেক সময়ের ব্যাপার।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনোর ক্ষতি মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে ব্যাংকগুলো গ্রাহক বুঝেই ঋণ দেবে। যেসব গ্রাহক ক্ষতি পুষিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না, তাঁদের ঋণ দিয়ে কোনো উপকার হবে না। শুধু শুধু খেলাপি ঋণ বাড়বে, এতে আরও বড় সংকট দেখা দেবে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কারা ঋণ পাবে, কারা পাবে না, তার একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। তাহলে ব্যাংকগুলোর জন্য সুবিধা হবে। অযথা চাপ তৈরি হবে না।
প্যাকেজে যা থাকছে
একনজরে দেখে নেওয়া যাক, কোন খাতের জন্য কী ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ এপ্রিল করোনার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষত মোকাবিলায় ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর আগে রপ্তানি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন চারটিসহ পাঁচটি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৯ শতাংশ সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যাংক ও গ্রাহকদের সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো। ঋণের সুদের সাড়ে ৪ শতাংশ ঋণগ্রহীতা পরিশোধ করবে ও বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে (এসএমই) চলতি মূলধন দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঋণের সুদহারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। এ ঋণও ব্যাংক–গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে দেবে ব্যাংকগুলো।
রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মাশুল দিয়ে রপ্তানিমুখী সচল কারখানাই ঋণ নিতে পারবে, যা দিয়ে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারবে।
পাশাপাশি রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার ও সুদহার ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
ব্যবসা শুরু সময়সাপেক্ষ
সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, এই পাকেজকে সুদ ভর্তুকি বা কম সুদের ঋণের প্যাকেজ বলা যায়। গত এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলো এমনিতেই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হলো, তা নিরূপণের পরই ব্যবসায়ীরা নতুন করে শুরু করবেন। পাশাপাশি ভাইরাসের প্রকোপে ভোক্তা চাহিদা কতটা কমে, এটাও মাথায় রাখছেন ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে ঋণ পায়, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, শুধু তারাই যেন এ সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখেই অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদেরও এ প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বাছাই ও ঋণ বিতরণে একটা টাস্কফোর্স গঠন করলে ভালো হয়।
আবুল কাসেম খান এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক। তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। প্রকোপ শেষ হলে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে, সেটা সময়সাপেক্ষ।
তাই সরকারের এ প্যাকেজ পুরোটা কাজে লাগবে, না আরও বড় প্যাকেজ দিতে হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে টিকে থাকতে ব্যবসায়ীদের সাহস জুগিয়েছে সরকারের এ প্যাকেজ।