অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
রাজননৈতিক প্রতিহিংসার কারনে মিথ্যা মামলায় টানা দুই বছর বন্দী জীবন পার করছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। মূল নেত্রীর মুক্তির প্রশ্নে এখন অনেকটাই কুলকিনারাহীন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি অনিশ্চিত। রাজপথেও নেই শক্ত আন্দোলন। নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসা, তাহলে তার এই কারাবাস কি আরো দীর্ঘায়িত হবে? নাকি কোনো না কোনো পথে তার মুক্তি প্রক্রিয়ার দ্বার হঠাৎ করে খুলে যাবে। জানা গেছে, বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে নানা পক্ষের তৎপরতা থেমে নেই। পর্দার অন্তরালে আলোচনা চলছেই, আছে দৌড়ঝাঁপ। অনেকেই বলছেন, ক্ষমতাসীনদের সিদ্ধান্তেই মুক্তি পেতে পারেন খালেদা জিয়া।
২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি। রাজনীতির ময়দানে টানটান উত্তেজনা। দলীয় নেতাকর্মীরা শোডাউন সমেত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পৌঁছে দেন আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। কথিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার বিরুদ্ধে সেদিন রায় ঘোষণা করেন আদালত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয় পাঁচ বছর কারাদণ্ড। পুরান ঢাকার কারাগারে ঠাঁই হয় তার।
দুই বছর পর আজ পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। কথিত সেই মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ১০ বছর হয়েছে হাইকোর্টে। আরেকটি মামলায় আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সবমিলিয়ে ১৭ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। গত বছর এপ্রিল থেকেই বিএসএমএমইউতে আছেন তিনি। নানা রোগে অনেকটা কাবু । একদল চিকিৎসক তার পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না খালেদা জিয়া। কয়েকবার তার জামিন আবেদন নাকচ করেছেন আদালত। তবে তার উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের।
কিন্তু বিএনপিকে দেখা যায়নি কোন শক্ত আন্দোলনে নামতে। খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবে না বলে বিএনপির নেতাদের কথার ফুলঝুরি থেমে ছিলো না। কিন্তু ডা. কামালের প্ররচনায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এরপর আর কঠোর কোন আনন্দোলনে নামতে দেখা যায়নি এই রাজনৈতিক দলটির।
এখন প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য তার দল কি করছে? বিএনপি নেতারা কি আসলেই খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়? বিএনপি নেতারা যে প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে খালেদা জিয়াকে কি তারা জীবিত অবস্থায় মুক্ত করতে পারবে? এসব প্রশ্ন এখন রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষের মনে।
আর এসব প্রশ্ন তোলার যুক্তিসংগত কারণও আছে। কথিত দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর বিএনপি নেতারা ঘোষণা দিলেন যে তারা সরকারের উসকানিতে পা দেবেন না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তিতো দূরের কথা উন্নত চিকিৎসার জন্যও তারা সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেকোনো আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এমন কি সরকার পতনের আন্দোলনের জন্যও তারা প্রস্তুত। কিন্তু, দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা রহস্যজনক কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কোনো কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা দিচ্ছে না। এখন দিন যত যাচ্ছে এনিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর ততই ক্ষুব্ধ হচ্ছে।
রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ মনে করছেন, বিএনপির বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে জীবিত অবস্থায় খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সরকার যা চাচ্ছে তাই হবে। হয়তো একদিন শোনা যাবে, খালেদা জিয়া আর নাই। সেদিন মির্জা ফখরুলসহ কেন্দ্রীয় নেতারা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে খালেদা জিয়ার লাশ গ্রহণের জন্য কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবেন। আর সাথে কিছু নেতাকর্মী থাকবে যারা স্লোগান দিবে যে, আমরা এর কঠিন প্রতিশোধ নেব। এর বেশি আর কিছু হবে না।
পরিবার বলছে, তার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষ আবেদন দায়েরের চিন্তা করছেন তারা। অবশ্য কী সে আবেদন তা পরিষ্কার নয়। যদিও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় সরকার চাইলে সাজা স্থগিত করে যেকোনো ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যাতিত এই বিধি কার্যকরের সম্ভাবনা কোথায়?
গত দুই বছর ধরে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ‘গুঞ্জন’ চলছে। সর্বশেষ গুঞ্জন উঠে হাসপাতালে সেজবোন সেলিমা ইসলাম অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখে আসার পর। তার মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ শুনানি করে খারিজ করে দিলে আইনি পথে মুক্তির পথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই গত ২৪ জানুয়ারি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে সেলিমা ইসলাম বলেছিলেন, তার বোনের মুক্তির বিষয়ে নতুন করে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে গেলেও পর্দার অন্তরালের তৎপরতা থেমে নেই। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বাইরেও একটি পক্ষ এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছেন। ওই পক্ষটি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিপত্তি হচ্ছে বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিতে কোনোভাবেই রাজি নন। তার সাথে সাক্ষাৎকালে পরিবারের সদস্যরা প্যারোলের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে, তিনি তা একাধিকবার সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। প্যারোলের পরিবর্তে কি হতে পারে? একটি বিশেষ আবেদনের কথা এ ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে। যার মাধ্যমে বেগম জিয়ার সাজা স্থগিত করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতে পারে। এই প্রক্রিয়া কিছু দূর এগিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।
একটি সূত্রের দাবি অনুযায়ী বেগম জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে সম্প্রতি সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা সংশ্লিষ্ট একজনের সাথে সাক্ষাৎ করে কথা বলেছেন। বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানোর বিষয়ে ওই সাক্ষাতে কথা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের মূল ফোকাস মুজিববর্ষ উদযাপন। এই বর্ষে নতুন কোনো রাজনৈতিক ঝামেলা তারা চাচ্ছেন না। সেই কারণে কোনো কোনো পক্ষ বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়াই শ্রেয় মনে করছে। যদিও সরকারের ভেতরে বেগম জিয়ার বিষয়ে কট্টরপন্থাও রয়েছে। তারা এ বিষয়ে নূ্যূনতম কোনো ‘ছাড়’ দিতে রাজি নয়।
বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়া বা যেকোনো নাগরিকের দণ্ড স্থগিত করে জামিন দেয়ার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে এই ধারায় যেকোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এটা তাদের মানবিক দায়িত্ব।
খালেদা জিয়ার অন্যতম প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আইনগত প্রক্রিয়ায় কিভাবে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি হতে পারে সে বিষয়ে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় যেখানে দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়। তিনি বলেন, আমি প্রথম থেকে বলে আসছি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়াকে) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলে নেয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবেই যদি বিএনপি মাঠ উত্তপ্ত করে সরকারকে বাধ্য করতে না পারে তা হলে ম্যাডামের মুক্তি সম্ভব হবে না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ৪০১(১) ধারায় বেগম জিয়ার মুক্তির সুযোগ রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে যেকোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এটা সরকারের একক দায়িত্ব এখানে কারো কোনো আবেদন করতে হয় না। আমি আশাকরি মানবিক দায়িত্ব সরকার পালন করবেন। তার সাজা স্থগিত থাকবে, বহাল থাকবে। তিনি যখন সুস্থ হয়ে আসবেন তখন সাজার বিষয়টি আসবে। তা যদি না করেন, এই মুহূর্তে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে বের করতে হবে বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে তার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর আমরা নতুন করে জামিন আবেদন করার চিন্তা করছি। এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সময় আছে, নতুন করে জামিন আবেদন করব। বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় সরকার যেকোনো সময় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার দুপুরে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে বিএনপির। বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও আজ সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রতিবাদ সভা করবে। শীর্ষ নেত্রীর কারাবন্দীর বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিচার ব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। এখন তাকে তার সাংবিধানিক যে প্রাপ্য জামিন পাওয়া সেটাও দেয়া হচ্ছে না। বার বার আদালতে গিয়েও কি হয়েছে তা সবাই জানেন, দেখছেন। তিনি বলেন, দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য বিএনপি আন্দোলনের মধ্যে আছে।
৭৫ বছর বয়স্ক খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছিলেন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে রাজনীতিতে আসতে হয়। তবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে শক্ত ভূমিকা রেখে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেন। এরশাদের পতনের পর নির্বাচনে জয়ী হয়ে চমক দেখান। ১৫ই ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে অবশ্য স্বল্প সময় ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০১ সালে ভূমিধ্বস জয় পান। সেসময়কার বিএনপি সরকার নানাভাবেই সমালোচিত। ওয়ান ইলেভেনে আসা বিপর্যয় এখানো কাটাতে পারেননি খালেদা জিয়া এবং তার দল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে ৩৫টি মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি। খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে তার আইনজীবী ও বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় জেলে আটকে রেখেছে। অসুস্থতা ও মানবিক দিক বিবেচনা করে জামিন আবেদন করলেও তাকে জামিন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এতে আইনজীবী ও বিএনপির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদরা কেউই ব্যর্থ নন। আইনজীবীরাতো তাদের আইনি লড়াই অব্যাহত রেখেছেন। অপরদিকে রাজনীতিবিদরাওতো কম আন্দোলন করেনি। তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা। জমি জমা বিক্রি করে এখন তাদের অনেকেই অর্থ কষ্টে ভুগছেন। আন্দোলন করলেই সরকার নতুন নতুন মামলায় জড়িয়ে দেন। বিএনপির নীতি নির্ধারকদের বেশ কয়েকজন মামলার দণ্ড মাথায় নিয়ে দিন পার করছেন।