আহমেদ আফগানী
ভারত গোড়া থেকেই একটি হিন্দু রাষ্ট্র। ভারত নতুন করে হিন্দু রাষ্ট্র হতে চাইছে এমন মনে করা ভুল। ভারত হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র হতে চায় কি চায় না, সেটা আসলে মূল ইস্যু নয়, কারণ ভারত সবসময় হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র ছিল। বরং স্যু হলো সম্প্রতি যে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) পাস করা হয়েছে এবং যে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর কি প্রভাব পড়বে ভারতের উপর?
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যাদেরকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ভারতে খুব সামান্যই মুসলিম অভিবাসী এসেছে। তাই, কার্যত বাংলাদেশী মুসলিমরাই এখানে টার্গেট এবং সেই সাথে যে সব ভারতীয় মুসলিমরা এই বিভাজনের ব্যাপারে উদাসীন, তারাও এর অংশ। CAA এবং NRC অধিকাংশ ভারতীয় হিন্দু পছন্দ করে, এটা হলো বাস্তবতা।
পাকিস্তানী মুসলিম, বাংলাদেশী মুসলিম এবং প্রায় ২০০ মিলিয়ন ভারতীয় মুসলিম – সবাই এই ক্যাটেগরিতে পড়ে। পাকিস্তান একটা শত্রু দেশ, তাই এটা কোন ব্যাপার নয় এবং কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও পার পেয়ে গেছে, এতে ভারত আরও সাহসী হয়েছে। সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা থেকেও ভারতের জন্য পাকিস্তান ততটা শক্তিশালী না হলেও তাকে ‘দানব’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়, যাকে সবাই ঘৃণা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কিভাবে এই সমীকরণে পড়তে পারে, যেখানে বাংলাদেশকে প্রায়ই ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলা হয়ে থাকে?
শুধু যে মুসলিমরা বিপদে পড়তে যাচ্ছে এটা নয়। ক্ষতিগ্রস্থ হতে যাচ্ছে হিন্দুরাও। সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো – বিশেষ করে আসাম এসব আইন ভালোভাবে দেখছে না। ভারত ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে তারা বাঙালি বিরোধী, বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলিম উভয়েরই বিরোধী। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বলছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বাঙালি মুসলিমদের এখানে আগমনের মধ্য দিয়েই সমস্যা তৈরি হয়েছে কিন্তু আসামের মানুষ বিজেপির মতো করে ভাবছে না।
মমতার পশ্চিম বঙ্গ এবং আরেকটি বিক্ষুব্ধ কেন্দ্র এখানে যুক্ত হচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে ভারত একটা অস্থিরতার সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংস হয়ে উঠতে পারে। অন্যটি হলো ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাদের দুর্বল সম্পর্ক যারা এই বিলের অভিযোগগুলো নিয়ে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না। এই সব কিছু কি কাম্য ছিল?
ভারতের মুসলিমরা এরই মধ্যে বিক্ষোভে নেমেছেন, তাদের সহায়তা দিচ্ছেন উদারপন্থী এবং সমাজকর্মীরা। কংগ্রেস দলও এর সাথে যোগ দিয়েছে কারণ তারা নিজেদেরকে ‘সেক্যুলারিজমের নাইট’ বলে দাবি করে। আরও বেশ কিছু গ্রুপ এই বিক্ষোভের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।
অর্থনীতিতে ভারত খুব একটা ভালো করছে না এবং সে কারণেই অনেকে বলছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিলটি উত্থাপন করেছেন যাতে দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিক থেকে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া যায়। এটা বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও বটে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার খুব কম ভোটারই দলীয় ম্যানিফেস্টো নিয়ে মাথা ঘামায়। তারা নিজেদের ভেতরের তাড়না দিয়ে চলে এবং বিজেপি তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা ‘বহিরাগতদের’ বের করে দিয়ে হিন্দুদেরকে ‘অন্তর্ভুক্ত’ করবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিজয় ভালো কিন্তু রাজনীতিতে এর স্থায়ীত্ব খুবই ক্ষণস্থায়ী।
ভারতের অর্থনীতি কেমন খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদের চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২৫%-ই ভারতের নাগরিক। সব অর্থনীতিই উন্নত হয় এবং ভারতেরটাও হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে ভারতকে নিয়ে যেতে চান মোদি এবং এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য। কিন্তু অস্থির পরিবেশে নাগরিকত্ব ইস্যু হয়তো এই সময়টাকে পিছিয়ে দেবে এবং সম্ভবত লক্ষ্যমাত্রার আকারও কমিয়ে আনবে।
ভারতের জন্য আরও খারাপ দিক হলো, ভারতের প্রধান বাণিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বী চীন দক্ষিণ এশিয়ার উষ্ণ সাগরে আরও স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটবে যেখানে অনেকেই তাদেরকে ভারতের চেয়ে কম শত্রুসুলভ মনে করে। ভারতের প্রধান উদ্বেগ হলো বাংলাদেশ এখন চীনের জোরালো পদচ্ছাপের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কার্যত, চীন গত চার বছরে তাদের প্রভাব এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তারা মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে এবং বাংলাদেশের এক নম্বর অংশীদার হিসেবে ভালো ব্যবসায় তারা করেছে।
আসাম বা ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলোতে যদি গেরিলা তৎপরতার পুণরুত্থান ঘটে, বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে তাদের আশ্রয় দিতে পারে যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও তাদের সমর্থন দেয়া হবে না। কিন্তু ইটের বদলে পাটকেল হিসেবে অনেকেই হয়তো এ ধরনের পদক্ষেপকে সহায়তা করতে আগ্রহী। ভারতীয়রা যদি বাঙালি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদেরকে ফেরত পাঠায়, তাহলে সমস্যার সাথে পরিচিত একটা দেশের জন্য হয়তো সেটা বেশি সমস্যার হবে না, কিন্তু এতে ভারতকে আরও কুৎসিৎ এবং বাংলাদেশকে ভালো দেখাবে। এবং সেটা ভারতের উপর থেকে নির্ভরতা কমাবে। এবং এটার কারণে চীনের সাথে চুক্তি করা সহজ হবে।
উত্তপ্ত কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ছে। চরম ক্ষুব্ধ অবস্থায় আছে ভারতের ২০০ মিলিয়ন মুসলিম, প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ খুবই অখুশি। পশ্চিম বঙ্গ ক্ষুব্ধ, গণহত্যা নজরদারির তালিকায় স্থান পেয়েছে আসাম, যেখানে অর্থনীতিতে নজর দেয়া উচিত, সেটা দেয়া হচ্ছে না। এই অবস্থায় প্রশ্ন হলো সিএএ আর এনআরএস থেকে কি অর্জন করছে ভারত?