সাগুফতা শারমীন তানিয়া
বিষয় যদি র্যাগিং
আমার জীবনের প্রথম র্যাগিং এর অভিজ্ঞতা বুয়েটে। কর্তব্যরত শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষ থেকে বের করে দিয়ে প্রথমে চার ঘণ্টা একটা জানালাহীন ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখা হলো। তারপর মেয়েদের কাঠের এবং ছেলেদের লোহার টুল মাথায় নিয়ে একতলা থেকে চারতলা ওঠানামা করানো হলো।
তারপর?
চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে একটি স্টুডিও বা ক্লাসঘরে ঢুকতে বাধ্য হওয়া, হামা দিয়ে ছাড়া যেন ঢোকা না যায় সেজন্য বড় বড় লোহার টেবিল দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে দরজার মুখটা। প্রত্যেকে চার পায়ে ঢুকবে, এই টেবিলের তলা দিয়ে।
টেবিলের ওপর উৎসাহী ভাইয়ারা ময়দা, ডিম, নীলের গুঁড়ো, মুরগী-খাসি-গরুর হাড়, চকের গুঁড়ো নিয়ে অপেক্ষা করছে। যে যে ঢুকবে তার মাথা এবং শরীরে মাখিয়ে দেয়া হবে।
র্যাগিং-এর আগে কোন মেয়ে যেন বড় গলার কামিজ পরে না আসে, সেই বিষয়ে আগেভাগেই আপারা জানিয়ে দিয়েছিল… এরপর এক ক্লাস বোঝাই সিনিয়রদের সামনে দাঁড়ানো। কেউ কিছু করতে অস্বীকার করলে অকথ্য গালি আর চড়-থাপ্পড়ও আছে, আছে গায়ে-মাথায় ঢিল আর ভুক্তাবশেষ হাড় ছুঁড়ে মারা।
এরপর যা যা আমাদের করতে বলা হলো, লিখতে বলা হলো, বলতে বলা হলো আর যে নামে আমাদেরকে ডাকা হলো, সেই গল্প আরেক দিনের। সবচেয়ে সাধারণ গল্পটাই একটু বলা যেতে পারে।
আমার এক সহপাঠিনীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “এই তুই খালি না ভরা?”
সে মিনমিন করে বলেছিল, “খালি।”
আর হৈহৈ করতে করতে সিনিয়র ছেলেরা বলেছিল, “তুই খালি থাকলেই কী, ভরা থাকলেই কী!” আমার সেই বন্ধু যাকে বলে ‘দেখতে ভাল নয়’, সে যে মাথা নিচু করে তিক্ত চোখের পানি ফেলেছিল তা আমি কখনো ভুলব না।
আমার মনে আছে, পলাশী থেকে মিরপুর পুরোটা রাস্তা আমি অপমানে ডুকরে কেঁদেছি। ঘরে ঢুকছি, আব্বা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার মাথা বোঝাই ময়দা আর নীলে, ধুলায় আর খড়িতে ভরা জামা, আমার চোখ লাল। আমার মুখ বেঁকে গেছে রাগে।
ও আচ্ছা, আমাদের এক স্যারের মেয়ে ভর্তি হবার বছর থেকে ফ্যাকাল্টিতে র্যাগিং বন্ধ করা হয়েছে। খবরের কাগজে আবরারের মৃতদেহ দেখে আমি একটুও চমকাইনি।
বিষয় যদি শিক্ষক
”বুয়েটের ভিসি: সরকারের সর্বমহল জানে আমি কি করেছি
শিক্ষার্থীরা: স্যার, আমরা জানিনা( চিল্লায়ে)!
ভিসি: আমি জবাবদিহিতা করতে আসিনি
শিক্ষার্থী (রাইসা): সবাই সন্তুষ্ট স্যারের কথায়?
ভিসি: রাইসা…”
আমি এইটুকু পড়লাম ফেসবুকে। এরপর কী হতে পারে তা আমার মুখস্থ। এই রাইসাকে অকুস্থলে জিজ্ঞেস করা গেল না— “এই মেয়ে, তোমার রোল নাম্বার কত?” সেটাই স্যারের জন্য দুঃখের বিষয়। পরে অবশ্য সেই দুঃখের দিন কেটে যাবে।
কে কে স্যারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল, কে কে ঐসব ছেলেদের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠিয়েছিল সেইসব তালিকা করা হবে। তদন্ত কমিটি হবে। সেখানে রাইসার নাম থাকবে।
রাইসার অনুষদের নবীনতম শিক্ষক-শিক্ষিকারাও (যাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ তখনো অবশিষ্ট আছে বলে ভাবা যেতে পারতো) ক্লাসে এসে বলবে — “ভাবতে আমাদের লজ্জায় মাথা কাটা যায় যে আমাদের ফ্যাকাল্টির ছাত্রছাত্রীর নাম তদন্ত কমিটির তালিকায় আছে।”
তদন্ত কমিটিতে অবশ্যই সেইসব স্যার থাকবেন, যিনি/যারা বলতেন— “আওয়ারাগার্দি করতে এসেচ্চো বুয়েটে তাই ন্না? ছনি মরছে ছনি মরছে ছনি তুমাদের কী ল্লাগে? সপগুলাকে একসাতে ফেল করায়া দিব…”
স্যার তদন্ত কমিটির নামে জিজ্ঞেস করবেন, “রাইছা এই ছ্যালেদের কারা কারা তুমার আসল শত্রু? কারা তুমার গায়ে হাত দিয়েছে, মানে ধরো সিঁড়িতে যাইতে যাইতে কনুই দিয়া বুকে টাচ করেছে এমন।” (স্যার কনুইয়ের ভঙ্গি দিয়ে দেখাবেন)
তদন্ত কমিটিতে রাইসার উত্তরগুলিই লেখা হবে, রাইসাকে করা প্রশ্নগুলি লেখা হবে না। তদন্ত কমিটির কোনো এক ম্যাডাম রাইসাকে ফোন দিয়ে বলবেন, “যাদের নাম তুমি বলেছ, তাদের কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারে, ভাল হয় তুমি যদি ফ্যাকাল্টিতে কয়েকদিন না আসো।” আরেক স্যার বলবেন, “এই মেয়ে ক্যামনে পাশ করে আমরা দেখব! ফ্যাকাল্টির বদনাম করলো, বুয়েটের ভাবমূর্তি নষ্ট কল্লো!”
হাজার হাজার ছেলেমেয়ে থেকে ছেঁকে নেয়া কয়েকশত ছেলেমেয়ের ভিতরের একজন রাইসা। সে এইভাবে হয়তো পাশ করবে, নয়তো কয়েকবারে পাশ করবে, নয়তো জীবনের প্রথম সেকেন্ড ক্লাস পাবে, নয়তো তার সেই ক্লাসমেট মেয়েটির মতো কোনোদিন পাশ করবে না (যে মেয়েটা তার সহপাঠীর দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল কিন্তু ভয়ে টুঁ শব্দ করেনি,ভয়ানক ট্রমায় সে আর পাশ করতে পারেনি।)।
“পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আমরা যুদি চাই, এক দিনে সব্বাইরে ফেল করায়ে দিতে প্পারি… দেখতে চাও তুমরা?”
দেখি তো স্যার। দেখলাম তো স্যার। সেই একই আপনি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দয়ার সাগর হয়ে যান, ছাত্রদের পরীক্ষার রেজাল্টে মার্ক ২০% বাড়িয়ে দিয়ে পাশ করাতে বলেন, যেখানে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আপনার পায়ে পায়ে আপনার ছাত্র কাঁদে— আপনি তার নাম্বার যোগ করতে ভুল করেছেন সেটা যে সে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই অন্যায় যেন আপনি মনে না রাখেন।
পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আপনি ক্লাসের প্রেজেন্স গড় করে সেইমতো ফাইনাল পরীক্ষার মার্ক দিয়েছেন, খাতা দেখেননি, ফলে যে ছাত্র পরীক্ষার দিন অনুপস্থিত ছিল সে পাশ করে গেছে। যে ছাত্রর বাপকে আপনার কাজে লাগবে তাকে আপনি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট বানিয়েছেন। যে ছাত্রর ডিজাইন আপনার পছন্দ হয়েছে আপনি তার ডিজাইন চুরি করেছেন। এবং আপনি আজকে আপনার এইসব কৃতকর্মের উপর দাঁড়িয়ে ভাবছেন, বুয়েটের এ কী হলো!
যেন শিক্ষকের অসততার, উদাসীনতার, অবিমৃশ্যকারিতার কত বড় ছাপ ছাত্রের জীবনে পড়ে, তা না জেনেই আপনি এতদূর এলেন তো, তাই না স্যার? এই যে যারা যারা আপনাদের কথা বলে দিচ্ছে এখন, সেইসব দুষ্টু ছেলেমেয়েদের শায়েস্তা করার কথা আপনি এখনো তো ভাবছেন তাই না?
বিষয় যদি সমাজ
মাত্র কিছুদিন আগে মারা গেল একটি ছেলে, তার নাম হৃদয়ঙ্গম, তার নাম ঋদ্ধ, কী মিষ্টি নাম! সে জানতো না ঢাকাশহরে কিশোরদের লেকে নামতে নেই, বাঁশি বাজিয়ে তন্ময় হতে নেই। এই শহরে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে নেই।
এইসব শহরে দেশকে দেশের প্রকৃতিকে দেশের নদীনালা বনাঞ্চলকে ভালবাসতে নেই। এই শহরেই না ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করেছিল বলে আপনারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পিটিয়েছিলেন? আরেক শহরেই না ত্বকীকে অসামান্য শারীরিক কষ্ট দিয়ে মেরেছিলেন?
শহর এবং গ্রাম, পরিবার এবং সমাজ একবাক্যে অসৎ, প্রতিষ্ঠান অসৎ এবং রাজনীতিতে নীতির কোনো স্থান নেই, সেখানে অনতিযুবকরা নওলকিশোররা তরুণরা দানব হতে না পারলে মরবে। ভাইয়ের রক্ত হাত থেকে মুছতে মুছতে ভাত খেতে যেতে না পারলে মরবে। হন্তারকদের তাঁবে হতে না পারলে মরবে।
আমরা অবাক হচ্ছি কেন? অমেধাবী-মেধাবী এইসব তর্ক করে তো লাভ নেই, অনেকদিন ধরে আমরা রক্তবীজ অসুরের রক্তবিন্দু ঝরিয়েই চলছি, অসুর উৎপাদন করেই চলছি।
বিষয় যদি পিতা
আবরার হত্যার ১৩ নং আসামী আকাশের ভ্যানচালক বাবাকে নিয়ে খবর হয়েছে—
১. বহু কষ্টে তিনি আকাশকে পড়িয়েছেন
২. বহু কষ্টে আকাশ পড়ালেখা করেছে
৩. অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন আকাশ ইঞ্জিনিয়ার হলে তাঁর দিন ফিরবে।
৪. সব আশা শেষ হয়ে গেল।
এই খবরের নিচে একটা কমেন্ট আমার মনঃপুত হয়েছে। সেখানে একজন বলছেন, এই বাপকে দিয়েই বোঝা যায় ছেলে কেন এমন অ্যাপাথেটিক। বাপ একটি কথা বলেনি আরেক বাপের সন্তানহানি নিয়ে, এবং সেই সন্তানহানিতে নিজের সন্তানের ভূমিকা নিয়ে।
পনেরো-ষোল বছর আগে আমি একটা খবর পড়েছিলাম, ছাত্রটির নাম ছিল আম্মার শামসী। তাকে তার দুই বন্ধু কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ আদায় করবে ভেবে মেরেই ফেলে, শালবনে গোর দেয়।
সেই কাঁচা কবরের লাশ যখন শেয়ালে নিচ্ছে তখন সেই দুই বন্ধু আম্মার শামসীর গলা নকল করে আম্মারের বাপের কাছে কেঁদে কেঁদে তাকে টাকা দিয়ে বাঁচাবার অনুনয় করেছে।
খবর আমাদের আসল খবরগুলি আর দেয় না। কেমন আছেন সেই আম্মার শামসীর বাবা যিনি এই পিশাচদের গলা নিজের ছেলের গলা বলে ভুল করেছিলেন?
কেমন আছেন অজয় রায় ছেলে অভিজিতের বিচার চেয়ে চেয়ে?
দীপন ভেতরে মৃত না জেনে তালাবদ্ধ প্রকাশনীর সামনে থেকে ফিরে যাওয়া বাবা আজ কেমন আছেন?
খুন হয় একটি সন্তানের, সে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যাই হোক না কেন। কিন্তু আমৃত্যু মৃত্যুদন্ড ঘটে যায় কত প্রিয়জনের। যাবজ্জীবন ভীতির কারাগারে ঢুকে যায় আরো কত মানুষ।
বিষয় যখন দেশ
“ইন্দিরা আইস্যা বঙ্গবন্ধুরে কইলেন, শেখ সা’ব, যুদ্ধ শ্যাষ, আপনে কী চান? শেখ সা’ব সিনা টান কইরা কইলেন—আমার দেশ থিক্যা আপনার ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার কইর্যা নেন!” বলতে বলতে গর্বে-অশ্রুতে জ্বলজ্বল করতো আমার আব্বা।
আমার দেশ, আমার নদী, আমার জলসীমা, আমার ভূগর্ভস্থ গ্যাস, আমার ম্যানগ্রোভ বনভূমি এ’সবকিছুতে আমার ভাইবোনদের বলবার অধিকার আছে, সেটা রক্ত দিয়ে কেনা নাগরিক অধিকার। আবরারসহ সকল ছাত্রের রাষ্ট্র নিয়ে সার্বভৌমত্ব নিয়ে বলবার অধিকার আছে, ছিল, তাই না?
লেখক: লন্ডন,বিবিসি