আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম)
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু নৃশংস, নির্মম, বর্বরোচিত ও পাশবিক ঘটনা ঘটেছে মানুষ চাইলেও যেগুলোকে ভুলে যেতে পারে না। কারণ, ঘটনাগুলো অতীতে ঘটলেও দিনগুলো বার বার মানুষের কাছে ফিরে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই নির্মমতার দৃশ্য। ইতিহাসের এমন একটি নৃশংস, পাশবিক, বর্বরোচিত ঘটনা হলো ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে বাংলাদেশের রাজধানী পল্টনের হত্যাকাণ্ড। সেদিন এদেশের জঙ্গি নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী হায়েনারা লগি-বৈঠা দিয়ে জামায়াত-শিবিরের ৬ জন নেতাকর্মীকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছিল। আওয়ামী হিংস্র জানোয়াররা শুধুহত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা লাশের ওপর উঠে নৃত্য করে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিল যে, আমরা মানুষ নয়, আফ্রিকার জঙ্গলের হিংস্র দানব। তাদের বর্বরতা আর পাশবিকতা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব।
প্রতিবছর যখনই এই হৃদয়বিদারক ২৮ অক্টোবর ফিরে তখনই মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে আওয়ামী হায়েনাদের সেদিনের বর্বরতা। শেখ হাসিনার গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিহত শহীদ মোজাহিদ, মাসুম, জসিম ও হাবিবুরদের হাসিমাখা চেহারাগুলো হৃদয় মানসে ভেসে উঠে। শত চেষ্টা করেও চোখ থেকে এগুলো সরাতে পারি না। আর চোখের সামনে ঘটা আওয়ামী হায়েনাদের এসব বর্বরতাকে কেমনে ভুলবো? এ যেনো মনে হচ্ছে-পল্টনে এক টুকরো কাঠ হাতে নিয়ে আওয়ামী হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। আর সাথীদের কেউ একজন পেছনে এসে বলছেন-এই ধরুন একটু পান পান করুন।
১৯৯১ সালে যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন শহীদি কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাওয়াত পাই। ৯৩ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে এই কাফেলার সঙ্গে কাজ শুরু করি। ছাত্রজীবনে এমন একটি এলাকায় সংগঠনের কাজ করতে হয়েছে যেখানে সব সময়ই বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। উপজেলার কোথাও আমরা প্রকাশ্যে কোনো প্রোগ্রাম করতে পারিনি। তখন রাসুল(স) এর মক্কী জীবনের ঘটনাগুলো বেশি বেশি পড়তাম। মক্কী যুগে নাযিল হওয়া কুরআনের আয়াতগুলো আমাদের কাজের সঙ্গে মিলাতাম। তখন মনে হয়েছে- নিজের মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকলেও আমার পথটা শতভাগ সঠিক। ব্যক্তিগতভাবে কারো সঙ্গেতো আমার শত্রুত নেই। কুরআনের দাওয়াত ছাত্র সমাজের কাছে দেয়ার কারণেইতো গালি শুনতে হচ্ছে, বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মানুষ রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিচ্ছে। এটাই ছিল তখন আমাদের শান্তনার বিষয়।
দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মখোমুখিও হতে হয়েছে। হাত বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে বলছে চোর ধরেছি। গলায় ছুরি ধরে বলেছে-স্বীকারোক্তি দে- আর কখনো শিবির করবি না। প্যান্টের বেল্ট খুলে পিঠে আঘাত করেছে। রক্ত ঝরেছে। যেহেতু সব কিছুই ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাই আল্লাহ সব সময়ই আমাদেরকে সাহায্য করেছে। দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময় বদরের যুদ্ধের কথা বলতেন। যেখানে আল্লাহ পাক ফেরেস্তা পাঠিয়ে মুসলমানদেরকে সাহায্য করেছিল। আমরা যদি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাই তাহলে বদরের মতো এখনো আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করবেন। নিজেও বিভিন্ন প্রোগ্রামে এবিষয়ে দারস দিয়েছি। তবে, আল্লাহর এই সাহায্য নিজের চোখে দেখার একটা বাসনা মনে সব সময়ই থাকতো। সেই ইচ্ছেটাও আল্লাহ পূরণ করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে পল্টনে নিজের চোখে আল্লাহর সাহায্য দেখার সুযোগ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।
সেই বছর ২৫ অক্টোবর ছিল ঈদুল ফিতর। আর ২৮ অক্টোবর ছিল বায়তুল মোকাররম গেটে ক্ষমতার মেয়াদ শেষে একটি সমাবেশ। ঈদে ঢাকা মহানগরীর জনশক্তির ছুটি বাতিল করা হয়। আর বৃহত্তর আন্দোলনের একজন চূড়ান্ত শপথের কর্মী হয়ে ছুটি চাওয়াটা ছিল আর কঠিন। তারপরও থানা আমিরকে বললাম-ঈদ করে ২৬ তারিখ চলে আসবো। থানা আমির জানেন-আমি কখনো কোনো কর্মসূচি মিস করিনি। তাই ছুটি দিলেন। কথা মতো ঈদ করে ২৬ তারিখে বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসলাম। রাতেই থানা আমিরসহ অন্যান্য দায়িত্বশীলদের ভাইদের সঙ্গে দেখা করলাম। তারা বলে দিলেন, আমার ইউনিটের সকল জনশক্তি নিয়ে দুপুর ২ টার মধ্যে পল্টনে থাকতে হবে।
২৮ তারিখ সকালে সকল জনশক্তিকে আরেকবার বলে আসলাম। মেসের বুয়া না আসায় নিজেই রান্না করলাম। কিন্তু খাওয়া আর হলো না। গোসল করে খেতে বসবো এমন সময় ওয়ার্ড সভাপতি এসে বললেন-পল্টনের ঘটনা জানেন? আমাদের ৬ জন ভাই শহীদ হয়েছেন। এখনি চলে যেতে হবে। উনার সঙ্গেই বের হয়ে গেলাম। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি সংকট। অনেক কষ্ট করে কাকরাইল মোড় গেলাম। সেখানে দাড়িয়ে থাকা এক ভাই বললেন-আপনারা নয়াপল্টন দিয়ে যান। এদিকে গেলে সমস্যা হবে। তারপর নয়াপল্টন দিয়ে দৈনিক বাংলা হয়ে উত্তর গেট গিয়ে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। সমাবেশ মঞ্চে মল্লিক ভাই ও কাশেম ভাইসহ শিল্পীরা শহীদি গান গাচ্ছেন। তখনো মঞ্চে নেতৃবৃন্দ আসেননি।
আমাদেরকে মুক্তি ভবনের সামনে দাড়াতে বলা হলো। আমরা সেখানেই অবস্থান নিলাম। আর পল্টন মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমপাশে আওয়ামী হায়েনারা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাদের টার্গেট হলো-জামায়াতের শীর্ষনেতৃবৃন্দ মঞ্চে আসলেই তারা আবার হামলা করবে। আমরা বাঁশ আর কাঠের টুকরো নিয়ে দাড়িয়ে আছি আর ওরা অস্ত্রে সজ্জিত। মুখোমুখি অবস্থান। সমাবেশের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক শুরু হওয়ার পরই পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষনেতৃবৃন্দ মঞ্চে আসার পরই তারা পুনরায় হামলা শুরু করলো। থেমে থেমে চলছে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। আমাদের ধাওয়ায় ওরা একাধিকবার পিছু হটেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদেরকে এক চুল পরিমাণও পেছনে নিতে পারেনি। ওই সময় আমাদের চূড়ান্ত ছিল-ওরা যদি আমাদেরকে নেতৃবৃন্দকে গুলি করে মারতে চায় তাহলে আমাদের লাশের ওপর দিয়েই তাদেরকে যেতে হবে। এ ছাড়া আমরা তাদেরকে সামনে এগুতে দেবো না।
আমিরে জামায়াত বক্তৃতা শুরু করার পরই ওরা ফায়ার করা শুরু করে। ওদের টার্গেট মঞ্চ দখল করা। আমি তখন একেবারে সামনের কাতারে ছিলাম। তখন দেখলাম-ওরা গুলি করছে কিন্তু এগুলো আমাদের কাছে আসছে না। ওদের প্রতিটি গুলিই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছে। আওয়ামী হায়েনারা গুলি ছুড়ছে আর আমরা বিপরীতে ইট মারছি। তখন মনে হয় আল্লাহ তার সাহায্যগুলো আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো ঢেলে দিয়েছিল। আমাদের কারো মনেই তখন মৃত্যুর বিন্দু পরিমাণ ভয় ছিল না। একবার নিচের দিয়ে তাকিয়ে দেখি হাটুর নিচ থেকে দুই পায়ে রক্ত পড়তেছে। এক ভাই বললেন-নিচের দিকে তাকালে আর দাড়িয়ে থাকতে পারবেন না। কিছু ভাই তখন বোতল দিয়ে পানি এনে পিপাসা মেটানোর ব্যবস্থা করেছে। ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষনেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার যে চক্রান্ত করেছিল জঙ্গি নেত্রী হাসিনা, আল্লাহর রহমত ও সাহায্যে সেই চক্রান্ত সফল হয়নি। আল্লাহ পাক মুমিনদেরকে সাহায্য করার যে ওয়াদা করেছেন, সেই ওয়াদা তিনি রক্ষা করেছেন পল্টন ময়দানে।
এখন বিষয় হলো-আমরা যদি সব সময় খালিস মুমিন হিসেবে কাজ করতে পারি তাহলে আল্লাহর সাহায্য আমরা সব সময়ই পাবো। আল্লাহতো তাদেরকেই সাহায্য করেন যারা গোপনে ও প্রকাশ্যে তাকে ভয় করে। তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলে।
আর জীবনের সব কিছুই তো আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। সাথী শাপথ, সদস্য শপথ, রুকনিয়াতের শপথ, ৯৩ সালে কর্মী হওয়ার সময় যেসব প্রতিশ্রতি দিয়েছিলাম সেগুলোও এক প্রকার শপথ ছিল। এক পর্যায়ে এসে এখন মনের মধ্যে অনেক ভয় জাগে। শপথের আলোকে কি নিজেকে গড়তে পেরেছি? আল্লাহর কাছে কি এসব কবুল হয়েছে? মৃত্যুর পর যদি আল্লাহ বলেন যে, তুমি জাহান্নামে যাও। তখন কী হবে?
আসলে জীবনের এসব বাহ্যিক কাজকর্ম আল্লাহ দেখবেন না। আল্লাহ দেখবেন আমাদের অন্তর। বাহ্যিকভাবে আমরা সংগঠনের চূড়ান্ত শপথ নিয়েছি। কিন্তু জীবন থেকে মিথ্যা-প্রতারণা কি ছাড়তে পেরেছি? উপার্জনের ক্ষেত্রে কি শতভাগ হালাল পথে উপার্জন করছি? জীবনের সর্বক্ষেত্রে কি গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে চলছি? হয়তো একদিন এদেশে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়বে। কিন্তু মৃত্যুর পর আমি-আপনি আমাদের খুলসিয়াতের কারণে জাহান্নামে যাবো। আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুন। আমাদের আমলগুলো কবুল করুন। তোমার দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে মৃত্যু পর্যন্ত অটুট থাকার তাওফিক দান করুন। তোমার দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা জীবন দিয়েছেন তুমি তাদেরকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন।