অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়াবহ জঙ্গি হামলা গুলশান অ্যাটাকের তিন বছর অতিবাহিত হলো গত ২ জুলাই। এ হামলায় জঙ্গিরা ব্যবহার করেছিল আধুনিক একে-২২ রাইফেল। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ ভয়ানক অস্ত্র কিভাবে দেশে প্রবেশ করেছিল তার সুনির্ধারিত তথ্য জানা না গেলেও, এ অস্ত্র যে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের পুলিশ।
২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘গুলশান হামলা’ মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন- ‘গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এসেছে ভারত থেকে। তবে অস্ত্রগুলোর গায়ে কোন দেশে তৈরি তা লেখা নেই। তাই বোঝা যাচ্ছে না এগুলো ভারত, পাকিস্তান, চীন না নেপালে তৈরি। তবে এগুলো এসেছে ভারতের ভেতর দিয়ে। এ ক্ষেত্রে নব্য জেএমবির সদস্য নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের একটা বড় ভূমিকা ছিল।’
গুলশান হামলার ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছিল তিনটি একে-২২ রাইফেল, পাঁচটি নাইন এমএম পিস্তল, ১৩টি ম্যাগাজিন, নাইন এমএম ক্যালিবারের ছয়টি তাজা গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ ক্যালিবারের ২৮টি গুলি, একে-২২-এর ৩৫টি গুলি, পয়েন্ট টুটু বোরের ৪৪টি গুলি, ৬ পয়েন্ট ১৬ ক্যালিবারের ১২টি গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু ক্যালিবারের দুটি গুলি, একই ক্যালিবারের ১৯৫টি গুলির খোসা, নাইন এমএম ক্যালিবারের গুলির ১০৫টি খোসা ও ৯টি গ্রেনেড সেফটি পিন, একটি চাপাতি ও দুটি ছোরা।
গুলশান হামলার পরে কি ওই অস্ত্র দেশে আসা বন্ধ হয়ে গেছে? সহজ সরল উত্তর- না। বরং নিয়ম করেই এই আধুনিক অস্ত্র অবৈধ পথে ভারত থেকে এনে অপরাধীদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে একটি চক্র। তেমনিভাবে গত ১ জুলাই গুলশান হামলার ঠিক ৩ বছর পূর্তির দিনে একে-২২ বোরের রাইফেলসহ দুইজনকে রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতারকৃতরা হলো- মোঃ কামাল হোসেন (৩৫) ও মোঃ সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল (৩০)। তাদের উভয়ের বাড়ি কুমিল্লার কোতয়ালী থানার শুভপুরে।
সিটিটিসি সূত্রে জানানো হয় ৩০ জুন, ২০১৯ রাত ৯:৪০ টায় সায়দাবাদের ওয়ান্ডার ল্যান্ড পার্কের প্রবেশ গেইটের পূর্বপাশে রাস্তার উপরে অভিযান পরিচালনা করে ওই দুইজনকে গ্রেফতার করে স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের আমর্স এনফোর্সমেন্ট টিম। এ সময় মোঃ কামাল হোসেনের দেহ তল্লাশী করে তার ডানহাতে থাকা কালো রংয়ের হাত ব্যাগের ভিতরে নীল চেকের লুঙ্গীর অংশ দ্বারা মোড়ানো ১টি একে-২২ বোরের রাইফেল, (লোহার বাটসহ লম্বা অনুমান ২৫ ইঞ্চি) ও উক্ত রাইফেলে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ম্যাগাজিন সংযুক্ত, ম্যাগাজিনে ১৫(পনের) রাউন্ড .২২ বোরের গুলি লোড অবস্থায় আটক করেন তারা। আর মোঃ সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল-এর পরিহিত প্যান্টের ডান পকেটে অনুমান সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ম্যাগাজিনে .২২ বোরের ১৫(পনের) রাউন্ড গুলি ভর্তি অবস্থায় জব্দ করে। উদ্ধারকৃত অস্ত্র-গুলির স্বপক্ষে আটককৃতরা কোন কাগজ/লাইসেন্স প্রদর্শন করতে পারেনি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে যে, এই রাইফেলটি চট্টগ্রাম থেকে ক্রয় করে তারা ঢাকায় এনেছিল বিক্রি করার জন্য।
শুনলে এটা মাছ তরকারি বিক্রির গল্প মনে হলেও প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকে এভাবেই দেদারছে দেশে আসছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।
২০১৭ সালের ০২ জুন নিউজ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরে অভিযান চালিয়ে দুটি রকেট লঞ্চার, ৬০টি এম সিক্সটিন রাইফেল, পিস্তল, ম্যাগাজিন, বেশ কয়েকটি গ্রেনেড, ডেটোনেটর, বোমা তৈরির বিস্ফোরকসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে পুলিশ। এত বিপুল পরিমাণের আধুনিক অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে পুলিশ কিছুই জানাতে পারেনি।
গতবছর (৩১ জুলাই ২০১৮) রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তার চরাঞ্চল থেকে ৪ উগ্রবাদী জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করে বগুড়ার ডিবি পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকেও একই অস্ত্র (একে-২২) উদ্ধার করে তারা। পুলিশের দাবি অনুযায়ী আটকদের কাছ থেকে আরও উদ্ধার করা হয় একে-২২ রাইফেলের ম্যাগাজিন, ১৫ রাউন্ড একে-২২ রাইফেলের গুলি, ২টি সচল বিদেশী ৭.৬৫ পিস্তল, ৩টি ম্যাগাজিন, ২টি বার্মিজ চাকু, ১টি পিস্তলের গুলির খালি খোসা, নগদ ৫৫ হাজার টাকা।
সীমান্তে এত এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানোর পরেও দেশে অবৈধ অস্ত্রের এই পাইকারি উপস্থিতি উদ্বেগের ভাঁজ ফেলছে সাধারণ জনগণের কপালে। অত্যাধুনিক এসব অস্ত্র যে শুধু উগ্রবাদীরাই ব্যবহার করছে তা নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের পাতি নেতাদের হাতেও দেখা যাচ্ছে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রমে রাজধানীসহ দেশজুড়ে ভারী অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিয়ম করে যার জোগান দিয়ে যাচ্ছে কথিত বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। দেশের প্রশাসন ও কর্তাব্যক্তিরা এসব অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের উৎস সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু অজানা কারণে দেশের অভ্যন্তরে এসব ভয়ানক মারণাস্ত্রের প্রবেশ ঠেকাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তারা অক্ষম।