ইবনে ইসহাক
গতকাল চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী, যুবলীগ ক্যাডার অমিত মুহুরী মারা গিয়েছে। কারাগারের ৩২ নম্বর সেলে রিপন নামের অন্য এক বন্দীর সঙ্গে অমিত মুহুরির মারামারি হয়। একপর্যায়ে রিপনের ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হন অমিত। বুধবার রাত ১০টায় এ ঘটনার পর আহত অমিতকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দিবাগত রাত একটার দিকে তিনি মারা যান বলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাধ্যক্ষ নাশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩২ নম্বর সেলে অমিত মুহুরিসহ তিনজন বন্দী ছিলেন। রাত ১০টার দিকে আরেক বন্দী রিপনের সঙ্গে অমিত মুহুরির কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রিপন ইট দিয়ে অমিতের মাথায় আঘাত করেন। গুরুতর অবস্থায় অমিতকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অমিত মারা যান।
অন্য দশটি ছেলের মতো চট্টগ্রামের রাউজানে গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল অমিত মুহুরী। এসএসসি পাস করে গ্রামের একটি বিদ্যালয় থেকে। শহরে এসে ত্রাস হয়ে ওঠে অমিত মুহুরী। কথায় কথায় গুলি ছোড়া ও ছুরি মারা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। তুচ্ছ ঘটনায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বুকে ছুরি চালাতেও হাত কাঁপে না তার। পুলিশের চোখে সে ‘ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর খুনি’। অন্তত অর্ধডজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় এক ডজন চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও হত্যা মামলা রয়েছে। গত ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট বাল্যবন্ধু ইমরানুল করিম ইমনকে খুনের পর ফের আলোচনায় এসেছে অমিত মুহুরীর নৃশংসতা।
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, ‘অমিত মুহুরী ঠাণ্ডা মাথার একজন ভয়ঙ্কর কিলার। ইমনকে নৃশংসভাবে খুন করে যে কায়দায় লাশ গুম করার চেষ্টা করেছে, একজন স্বাভাবিক মানুষ সেটি কল্পনাও করতে পারবে না। এ ঘটনায় আরও যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অতীতেও অনেকগুলো খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল অমিত।
চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডা. মনোরঞ্জন মুহুরী চেয়ারম্যানবাড়ির অজিত মুহুরীর ছেলে অমিত মুহুরী। এসএসসি পাস করে রাউজান পৌরসভার সুরেশ বিদ্যায়তন থেকে। এর পর চট্টগ্রাম শহরে এসে ওমর গণি এমইএস কলেজে ভর্তি হলেও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এর পর ক্রমে হয়ে ওঠে পেশাদার খুনি। পরিচয় দেয় যুবলীগ নেতা হিসেবে। নন্দনকানন, লাভলেন, হেমসেন লেন, ঝাউতলা, লালদীঘিপাড়, মোমিন রোড ও এনায়েতবাজার এলাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপ তার। এসব এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজিই তার মূল কাজ। এ ছাড়া ভাড়ায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বন্ধু রাসেলকে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুনের মধ্য দিয়ে উত্থান
২০১২ সালে নগরের মোমিন রোডের ঝাউতলা এলাকার যুবলীগ কর্মী মো. রাসেলের সঙ্গে পরিচয় হয় অমিত মুহুরীর। দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠে সখ্য। একপর্যায়ে নারীঘটিত বিষয় নিয়ে দু’জনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এর জেরে অমিত মুহুরীকে মারধর করেন রাসেল। পরে প্রতিশোধ নিতে অমিত মুহুরী তার সহযোগীদের নিয়ে রাসেলকে তুলে নিয়ে যায়। আগ্রাবাদের জাম্বুরি মাঠে নিয়ে বেধড়ক পেটায়। শরীরে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুুঁচিয়ে তাকে নিপীড়ন করে। একপর্যায়ে মৃত মনে করে মাঠে ফেলে যায় তারা। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় রাসেলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক মাস নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর দেশ ছেড়ে পালায় অমিত। পরে ফিরে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে আসে।
সিআরবি জোড়া খুনের ঘটনায় আলোচনায় অমিত
২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি সাত রাস্তার মোড় এলাকায় রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে খুন হয় সিআরবি এলাকার মো. ছিদ্দিকের ছেলে মো. আরমান (৮) ও লাভ লেন এলাকার যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত (২৫)। চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের মামলায় অন্যতম আসামি অমিত মুহুরী। ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর এ ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর পর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের খাতায় নাম ওঠে তার। অপরাধজগতেও বেড়ে যায় তার কদর। এরপর ক্রমে নিজেই গড়ে তোলে আলাদা বাহিনী।
বাল্যবন্ধুকে নৃশংসভাবে খুন করে অমিত
রাউজান পৌরসভা এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে ইমরানুল করিম ইমন ও অমিত মুহুরী বাল্যবন্ধু। একই এলাকায় তাদের বাড়ি। গত ৮ আগস্ট রাতে অসুস্থতার কথা বলে নন্দনকাননের বাসায় ইমনকে ডেকে নিয়ে যায় অমিত মুহুরী। ৯ আগস্ট ভোরে লোমহর্ষকভাবে খুন করে তাকে। খুনের পর ড্রামের ভেতরে মরদেহ রেখে এসিড ও চুন ঢেলে সেটা গলিয়ে হাড়গোড় নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু একদিন পরও মরদেহ অবিকৃত থাকায় সেটি খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলার চেষ্টা করে। মরদেহ শক্ত হয়ে যাওয়ায় অমিতের সে পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। এর পর বালু ও সিমেন্ট দিয়ে ড্রামের ঢাকনা ঢালাই করে মরদেহ পাশের রানীর দীঘিতে ফেলে দেওয়া হয়। ১৩ আগস্ট দীঘি থেকে ড্রামভর্তি গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ৩১ আগস্ট অমিতের বন্ধু ইমাম হোসেন মজুমদার ওরফে শিশির (২৭) ও হরিশদত্ত লেনের বাসার নিরাপত্তারক্ষী শফিকুর রহমান শফিকে (৪৬) আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এর দু’দিন পর কুমিল্লার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে অমিত মুহুরীকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় খুনের দায় স্বীকার করে পরস্পরকে দায়ী করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে শিশির ও অমিত।
ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াছিন খুন
গত ১১ ফেব্রুয়ারি সিটি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিনকে দিনদুপুরে নগরের আমতলা এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অমিত মুহুরী জড়িত বলে দাবি সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতাদের। খুন হওয়ার কিছুদিন আগে ইয়াছিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর মধ্যে ইয়াছিনের ইয়ামাহা কোম্পানির এফজেডএস মোটরসাইকেলটি নিয়ে নেয় অমিত। মোটরসাইকেল চাইতে গেলে ইয়াছিনকে হুমকি-ধমকি দেয়। বিষয়টি ইয়াছিন তার রাজনৈতিক বড় ভাইকে জানালে তিনি অমিত মুহুরীকে পাল্টা হুমকি-ধমকি দেন। এর জের ধরে ইয়াছিনকে খুন করা হতে পারে বলে ধারণা ছাত্রলীগ নেতাদের।
এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বাকলিয়া এলাকায় মোটরসাইকেলে শোডাউন করে ত্রাস সৃষ্টি করে অমিত মুহুরী। এ বিষয়ে জানতে চাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুল হকের পায়ে প্রকাশ্যে গুলি চালায় সে। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন নগরীর ডিসি হিলে পুলিশের ওপর হামলা চালায় অমিত মুহুরী ও তার অনুসারী সন্ত্রাসীরা। গত ২৮ এপ্রিল রাতে নগরের কোতোয়ালি থানার মোমিন রোডের ঝাউতলা এলাকায় স্থানীয় কিশোর-তরুণদের দু’পক্ষ মারামারি শুরু করে। একপর্যায়ে পিস্তল উঁচিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালায় অমিত মুহুরী, যা সিসিটিভির ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এ ঘটনায় ২৫ মে তাকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। ২৬ জুন জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও স্বরূপে ফেরে ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসী।