অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সাম্প্রতিক সময়ের নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা। কখনও ছয় সন্তানের জননী, কখনও কলেজছাত্রী, বাদ যাচ্ছে না ৩-৫ বছরের শিশুও। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার খবর মিলেছে।
অভিযুক্তর তালিকায় শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, নারী ও শিশুরা কোথায় নিরাপদ?
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো তথা চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। এখন প্রশ্ন দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো মাধ্যমে কি এই পরিবর্তন সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু দৃষ্টিভঙ্গি নয় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা আবশ্যক। আর শুধু মাত্র সচেতনতা নয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। আর অপরাধ করলে পার নেই এ কথা বুঝিয়ে দেয়া। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-২০০৩)-এর ধারা ৯-তে বলা হয়েছে: ১. যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ২. যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী অন্য কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। ৪. যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া যদি কেউ ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
এখন প্রশ্ন বাংলাদেশে যথাযথ আইনের প্রয়োগ আছে কি?
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে শিশু ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। এ বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৪ জন শিশু। এরমধ্যে প্রতিবন্ধী ৭ জন। ধর্ষণচেষ্টা ও ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ২০ জন। আবার পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮ হাজার ৬৬৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে করা হয়েছে ৩ হাজার ৭১৭টি, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯২৮, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬৮৯, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৬৫০ এবং ২০১২ সালে ৩ হাজার ৬৮৪টি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসাবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ গবেষণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন এ সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে আইনে দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা বলছেন – আইনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিবিসির এক সাক্ষাতকারে কিছু কারণ তুলে ধরেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন। ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাবার মূল কারণ সাক্ষীর অভাব বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেছেন, এখন একটি বড় কারণ হচ্ছে, যিনি ঘটনার শিকার এবং অন্যান্য সাক্ষীরা যদি থেকে থাকেন, তারা অনেক সময় নানা ধরণের হুমকির সম্মুখীন হয়। সেই হুমকির ক্ষেত্রে তাদের কোন সুরক্ষা থাকেনা। বাংলাদেশে এখনো ‘ধর্ষণ’ সংজ্ঞায়িত করা হয় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী। এই আইনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং দণ্ডবিধিতে সাক্ষীদের রক্ষাকবচ সীমিত। কেউ ঘটনার শিকার হলে তার নাম প্রকাশ করা যাবেনা কিংবা প্রয়োজন হলে নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করতে পারে আদালত। কিন্তু এর বাইরে তেমন কোন সুরক্ষার ব্যবস্থার নেই।
সচেতন মহল বলছে, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে কঠোর আইন প্রয়োগ করে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। অন্য দিকে সমাজ থেকে নগ্নতা, ব্লু-ফিল্মের সহজলভ্যতা রোধ, অশ্লীল পত্র পত্রিকা ও বইয়ের রমরমা ব্যবসা বন্ধ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, ছেলে-মেয়েদেরকে যথা সময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুই সচেতনতা নয় বরং আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।