– হাসান রূহী
৪৮ ঘন্টা নয়, দীর্ঘ সাত বছর পার হলেও বিচার তো দূরের কথা হত্যার রহস্যই উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ওয়ালী উল্লাহ, আল মুকাদ্দাস, আমান আযমী, ব্যারিস্টার আরমান এভাবে নাম বললে ৪২৯ জন জ্বলজ্যান্ত মানুষের নাম বলা যাবে। ক্রসফায়ারের নামে স্রেফ গুলি করে খুন করা হয়েছে এমন অন্তত ১৩০০ মানুষের বিশাল তালিকা দেয়া যাবে। কিন্তু তাতে কি ওসব মানবাধিকারের কথা ছাড়ুন। চলুন কুকুরাধিকার নিয়ে একটু চর্চা করি।
কুকুরকে মুক্তভাবে চলাফেরার সুযোগ না দিয়ে একটানা সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁধে রাখলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য ছয় মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে আমাদের ভোটডাকাত মন্ত্রিসভা।
প্রাণিদের জন্য কল্যাণ করতে পারা অনেক ভালো খবর। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের মত মানুষগুলোর। আমরা যদি ওই প্রাণিকূলের কাতারেও শামিল হতে পারতাম! হোক না সে তুচ্ছ কিংবা নিকৃষ্ট প্রাণি কুকুর!
কুকুর ২৪ ঘন্টা বেঁধে রাখলে জেল জরিমানা হবে। এজন্য প্রাণিকল্যাণ আইন হচ্ছে। এসব নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটছে পেঙ্গুইন বেশধারী মন্ত্রীদের। মানবকল্যাণ নিয়ে ভাবার ফুরসত কোথায় তাদের? শুধু কুকুর নয়, রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা কোন ব্যক্তিকে আটকের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার আইন রয়েছে। কিন্তু তাতে কি! পুলিশ, র্যাব কিংবা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা কি সে আইনের তোয়াক্কা করছে? ২৪ ঘন্টার বেশি কোন মানুষকে আটক রাখলে আটককারীর কি শাস্তি হবে তা আমার জানা নেই। কিন্তু গতকাল ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন হওয়ার খবর পড়ার পর থেকে বার বার মনে হচ্ছে- হায়! যদি মানুষের জন্যও এমন একটি আইন থাকতো!
২৪ ঘন্টা নয়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী শিক্ষার্থী ওয়ালী উল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের গুম হওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় ফেরার পথে সাভারে নবীনগর থেকে তাদের তুলে নিয়েছিল র্যাব। কিন্তু তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউ জানে না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে এভাবে শত শত পরিবারে আহাজারির পরিবেশ সৃষ্টি করা হলেও এসব থেকে মুক্তি পেতে ‘প্রাণিকল্যাণ আইন’ এর মত ‘মানবকল্যাণ আইন’ এর কোন অস্তিত্ব নেই। যদি কোন আইন থেকেও থাকে অথবা ভবিষ্যতে প্রণীতও হয়, তবুও তা মানবতা ও মানবাধিকার রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা খুবই স্পষ্ট।
এসব তো গেল বিরোধী মতের কথা। একদলীয় বাকশালের দেশে কিসের বিরোধী দল? সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস আসে কোথা থেকে? ওদেরকে নাহয় এভাবেই দমিয়ে দিলেন। কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে হাজারে হাজারে লাল দালানে পুরে দিলেন। কিন্তু দলের লোকদের কি অবস্থা এখন? গতকাল দৈনিক প্রথম আলোতে অর্ণব সান্যালের ‘রক্ত যখন জেলি হয়ে যায়…’ শিরোনামে লেখা একটি কলামে চোখ আটকে গেল। সেই কলামের সাথে একটি ছবি জুড়ে দেয়া ছিল। যেখানে দেখা যায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন ২০১৬ সালে খুন হওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর তাঁর ছেলের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। প্রথম ময়নাতদন্তে বলা হয়েছিল, দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন। আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর জানা যায়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর জাহেদা আমিন বাদী হয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর টিপু, সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন।
কিন্তু দু’বছর ধরে পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে বিভিন্নভাবে সরকার বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও খুনীরা ধরা পড়েনি। শাস্তিও হয়নি। উপরন্তু পুরস্কৃত হয়েছে খুনী! ছেলের হত্যার বিচার দাবিতে এর আগে অনেক দিন প্রতিবাদ করেছিলেন জাহেদা, অনশনে ছিলেন। তাতে কারোরই কিছু যায়-আসেনি। এবার পুত্রের খুনীদের চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাতেও খুনীরা পুলিশের দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসেনি।
এর অবশ্য এক অদ্ভূত ব্যাখ্যাও দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ বুদ্ধিমান(!) পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান বলেছেন, ‘যাঁরা এ মামলার আসামি তাঁরা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। সে কারণে খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভুল করলে পার পাওয়া যাবে না। প্রমাণগুলো সঠিকভাবে না থাকলে সেখানে হাত দিতে পারব না। ভাসা ভাসা জেনে ক্ষমতাধর কাউকে ধরে আনাটা বুদ্ধির কাজ হবে না।’
দেশের প্রতিটি প্রান্তে দিয়াজের মায়ের মতই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মাথা ঠুকছে মানবাধিকার। রোনাজারি করছে মানবতা। কিন্তু তাতে কি! আপাতত চলুন কুকুরাধিকার রক্ষায় প্রস্তাবিত ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৮’ কে স্বাগত জানিয়ে পাড়ায় মহল্লায় প্রাণিকূলের মাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল, শোভাযাত্রা, সিম্পেজিয়াম, সেমিনারের আয়োজন করি। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য, মানবাধিকারের জন্য এত ভাবার সময় কোথায় বলুন?
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
“আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট