হাসান রূহী
গতকাল দেশের প্রায় সকল পত্রিকায় আলোচিত নাম ছিল তারা মিয়া। পুলিশের দাবি অনুযায়ী তারা মিয়া এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর নাম। যে নাকি চাপাতি, হকিস্টিক, লোহার রডের মত অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিল পুলিশের ওপর। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সুনামগঞ্জের অধিবাসী তারা মিয়া মূলত শারীরিক প্রতিবন্ধী দরিদ্র একজন মানুষ। তার ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন, নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না ডান হাত দিয়ে। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো। খুব কষ্ট করে বাম হাত দিয়ে খেতে হয়। ছবির এই মানুষটির ডান হাত অচল, বাম হাতও প্রায় অচল।
কিন্তু জন্মগতভাবে এমন একজন প্রতিবন্ধী মানুষ চাপাতি, হকিস্টিক, লোহার রড নিয়ে কিভাবে পুলিশের ওপর হামলা করতে পারলো? তারা মিয়া পেরেছে। গায়েবি শক্তিতে পেরেছে। যেভাবে সারাদেশে পেরেছে বিরোধী মতের হাজার হাজার নেতা-কর্মী। নির্বাচনকে সামনে রেখে পত্র-পত্রিকায় বেশ আলোচিত হয়েছিল পুলিশের গায়েবি মামলা। তারা মিয়া পুলিশের সেই নির্মমতার ছোট্ট একটি উদাহরণ মাত্র।
তারা মিয়া ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করেন। তাই তার সাথে করা এমন অন্যায়কে তুলে ধরেছেন কিছু বিবেকবান সাংবাদিক। আর সে খবর বিচারকের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মাত্র ৬ মাসের জামিনও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন শুধু তারা মিয়ার ভাগ্যেই কি এমন ঘটনা ঘটেছে?
আজ থেকে ১০ বছর পূর্বে ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচন প্রতিহত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে রাজপথে মোটামুটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু সেই প্রতিরোধকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একের পর এক ঘটলো রহস্যজনক পেট্রোলবোমা হামলা। মানুষের লাশ মিডিয়ার সামনে রেখে গণতন্ত্রকামী বিরোধী দলকে বলা হলো আগুন সন্ত্রাসী। এরপর তাদের উপর চালানো সীমাহীন জুলুম আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বৈধতা দেয়া হলো। দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ওপর চালানো হলো নির্মমতার স্টিমরোলার। মামলার বোঝা উঠলো তাদের ঘাড়ে। কিন্তু এ সবকিছুকেই বৈধতা দেয়া হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে।
গত ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচনের আগেও জনসমর্থনহীন এই সরকার আশঙ্কায় ছিল গণতন্ত্রকামী মানুষের গণপ্রতিরোধের। ফলে ভোট ডাকাতি নির্বিঘ্ন করতে হাজার হাজার বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের নামে করা হলো গায়েবি মামলা। যার অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ। এবং পুলিশের দাবি তাদের ওপর নাকি এসব নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে। দেশের কোন পেপার পত্রিকা কিংবা অন্য কোন মিডিয়ায় এসব হামলার প্রমাণ না থাকলেও গায়ের জোরেই এসব মামলা করেছে পুলিশ।
পুলিশী রাষ্ট্রে জনগণকে ফাঁসাতে পুলিশ মামলা করবে এটাই তো স্বাভাবিক! এসব জুলুম চালিয়ে জনসমর্থনহীন সরকারকে ফের ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা করার উপযুক্ত পুরস্কারও পেয়েছে তারা। ভূরিভোজ আর নানা রকম উপঢৌকনে রঙিন থেকে রঙিনতর হয়ে উঠছে পুলিশ বাহিনীর জীবন। কিন্তু তারা ভেবেও দেখছেনা যে, জনগণের হৃদয়ের রক্তক্ষরণেই মূলত দিনে দিনে রঙিন হয়ে উঠছে তারা!
তারা মিয়াকে শারীরিকভাবে অক্ষম দেখার পরেও বিচারক তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারেননি। সাধারণত অন্যান্য আসামীদের মতই তিনি ৬ মাসের জামিন পেয়েছেন। এরপর ভিক্ষার টাকা খরচ করে তাকে নিয়মিতই নিম্ন আদালতে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজিরা দিতে হবে। অনুমান করে বলা যায় সম্ভবত তারা মিয়াকে জামিন দেয়ার সামর্থ্য থাকলেও পুলিশের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারক কোন এক সুপ্রীম লিডারের বিরাগভাজন হতে চান না। যাইহোক, তারা মিয়াকে আপাতত লাল দালানের ভাত খেতে হলো না এটাই স্বস্তির খবর।
ভোটের পূর্ব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হাইকোর্টে হাজার হাজার জামিন প্রত্যাশী মানুষের ভিড়। স্থানীয় আ. লীগ নেতা ও পুলিশের দায়ের করা এসব মিথ্যা মামলা থেকে বাদ যায়নি কোন পেশার মানুষ। মামলা আর পুলিশী হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেকটা যাযাবরের জীবন বেছে নিয়েছেন বিরোধী মতের এ হাজার হাজার মানুষ। উচ্চ আদালতে দৌড়ঝাঁপ করে কোনো মামলায় জামিন পেলেও একাধিক মামলা থাকায় গ্রেপ্তার ও হয়রানির ভয়ে তারা এলাকায় যেতে পারছেন না। মামলার কারণে মানুষ নিজেদের কাজকর্ম করতে পারছেন না। এমনকি ৮২ বা ৮৩ বছরের বৃদ্ধের বিরুদ্ধেও নাশকতার মামলা করা হয়েছে।
নির্বাচনের আগে ও পরে স্থানীয়ভাবে যাতে প্রতিবাদ না হয় তার জন্য শত শত লোককে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। সেই কারণে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়ে পুলিশের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টের বারান্দায় দিনের পর দিন মানবেতর ভাবে অবস্থান করছেন। তারা মিয়ার মত আরও অসংখ্য অগণিত নিরীহ মানুষ রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হলেও কতটুকুইবা সুবিচার পাচ্ছেন? বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের ভাষ্যমতে, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চার কিংবা ছয় সপ্তাহের জামিন পাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু জামিনের মেয়াদ শেষে বিচারিক আদালতে গেলে অনেককেই কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। অনেককে জামিনের মেয়াদ বাড়াতে আবারও উচ্চ আদালতে আসতে হচ্ছে। আগাম জামিন পেলেও তাদের আতঙ্ক কাটছে না। অনেকেই ভয়ে এলাকায় যেতে পারছেন না। অনেকে মানবেতর ও যাযাবর জীবনযাপন করছেন।’
তারা মিয়ার খবরটি পত্রিকার পাতায় যারা এনেছেন তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সারাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার তারা মিয়ার খবর রাখে কে? জনগণের টুটি চেপে ধরে সিংহাসন আঁকড়ে ধরার উদাহরণ বিশ্বে কম নয়। কিন্তু তাদের কারো পরিণতিই ভালো নয়। সারাদেশে পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী মতের উপর ক্ষমতাসীন সরকার যে রাষ্ট্রীয় জুলুম শোষণ চালাচ্ছে তারা মিয়া তার এক নির্মম দলিল।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট