অধরাই থেকে যাচ্ছেন দেশের ইতিহাসে বড় কেলেঙ্কারির নেপথ্য নায়কেরা। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনের মারপ্যাঁচে আইনের আওতায় তাঁদের আনা যাচ্ছে না।
ব্যাংক খাতে জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত করলেও অদৃশ্য ইশারায় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অনেকে। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ কয়েকটি বড় জালিয়াতির হোতা হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা এখনো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে ‘ব্যাংকিং সেক্টর ইন বাংলাদেশ: মুভিং ফ্রম ডায়াগনোসিস টু অ্যাকশন’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলা হয়, বড় কয়েকটি জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের বড় কয়েকটি ব্যাংক থেকে এ অর্থ লোপাট হয়।
সরকারি-বেসরকারি এসব ব্যাংকে যা হয়েছে, তাকে চুরি নয়, ‘ডাকাতি’ ও ‘হরিলুট’ বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসায়ী নামের কিছু লুটেরা মিলেমিশে ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর অর্থ লুটপাট করেছেন।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় বা সামাজিক অবস্থান বিবেচনা না করে অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নির্মোহভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে তাঁদের বিচার করতে না পারলে এ ধরনের অপরাধ কমবে না।
বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির মামলায় ৪০ মাসেও অভিযোগপত্র নেই
বেসিক ব্যাংকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি এবং পরের বছর আরও পাঁচটি মামলা করে দুদক। এসব মামলা করার পর ৪০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অভিযোগপত্র দেয়নি সংস্থাটি। মামলায় ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের আসামি করা হলেও ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই আসামি করা হয়নি।
বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের জড়িত থাকার কথা বলা হলেও মামলায় তাঁদের আসামি করা হয়নি। মামলা হওয়ার পর তদন্ত–পর্যায়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অভিযোগপত্র এখনো জমা দেওয়া হয়নি।
বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় করা মামলাগুলোয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা অনেক দিন ধরে কারাগারে। ঋণগ্রহীতা কেউ কেউ ব্যবসায়ী। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁরা জামিনে বেরিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়েছেন। যাঁরা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাঁদের সবাই এখন বাইরে আছেন।
বেসিক ব্যাংকের তদন্ত সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, সব আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হবেন তাঁরা।
জনতা ব্যাংকে জালিয়াতির হোতারা বাইরে
জনতা ব্যাংকের বড় কেলেঙ্কারি নিয়ে দুদক একের পর এক অনুসন্ধান-তদন্ত চালালেও প্রতিবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন হোতারা। দুদক সূত্র জানায়, ২০১২ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয় গ্রাহকদের মধ্যে। ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদক কিছু ব্যক্তিকে ‘অভিযুক্ত’ করতে পেরেছিল, যদিও তাঁরা পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। কিন্তু অধরাই থেকে যায় ব্যাংকটির তৎকালীন ঋণ প্রদানকারী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। যখনই ব্যাংকটি ওই জালিয়াতির ঘটনার পর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখনই উদ্ঘাটিত হয় অ্যাননটেক্স গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। আলোয় আসে ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের চার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি।
এসব কেলেঙ্কারির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। ২০১২-১৩ সালে উদ্ঘাটিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানেও দেখা যায়, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির সুযোগটি তৈরি করে দেওয়া ২০০৮ সালে। ঘটনা চাউর হওয়ার আগেই লাপাত্তা হয়ে যান বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান, পরিচালক আনোয়ার চৌধুরী, নওরীন হাসিবসহ ঋণগ্রহীতারা। ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন জনতা, বেসরকারি যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা।
সম্প্রতি উদ্ঘাটিত অ্যাননটেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গেও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলেছে।
জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানপ্রক্রিয়ায় সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে জানান, ব্যাংকটিতে অনেক জালিয়াতির ঘটনাই ঘটেছে, যার দালিলিক প্রমাণ কষ্টসাধ্য। বৃহৎ ঋণগুলোর প্রস্তাব প্রেরণ, একেকটি ধাপ অতিক্রম এবং ঋণ মঞ্জুরের সময়কাল খুব সংক্ষিপ্ত। অর্থাৎ দ্রুতগতিতেই ঋণগুলো মঞ্জুর এবং টাকা ছাড় হয়। এ সময়কালে কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করলে দেখা যায়, আত্মসাতের সঙ্গে শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। অথচ এটি প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির সূচনা হয় ২০০৮ সালের দিকে। সে বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। ওই সময় অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের মতো ঋণগুলো অনুমোদন পায়। ওই আমলে দেওয়া ঋণের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি। এসব আত্মসাতের ঘটনায় দুদক এখন অনুসন্ধান শুরু করতে পারছে না।
দুদকের আরেকটি সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধান চলমান থাকলেও ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের ধরা যাচ্ছে না। দুদকের একাধিক অনুসন্ধানে ওই সময়ের ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীদের নাম এলেও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
ফারমার্স ব্যাংকের জালিয়াতি নিয়ে ধীরে চলছে দুদক
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী) কয়েকজন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। কোনো মামলায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে আসামি করা হয়নি।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে ব্যাংকটির সাবেক দুই শীর্ষ ব্যক্তির অনিয়ম তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত এ দুজনের সুপারিশেই। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁরা নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ফারমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তাঁরা।
জালিয়াতির হোতারা আইনের বাইরে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় জালিয়াতির ঘটনাগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করেছে, সরকারের কাছে সব তথ্য আছে। নতুন অর্থমন্ত্রীর কাছে বড় প্রত্যাশার কথা জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন অর্থমন্ত্রী একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট। তিনি এ বিষয়গুলো বোঝেন। আমরা চাই সব কটি বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে নতুন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
সূত্র: প্রথম আলো