মুসাফির রাফি
আমি ঢাকার ভোটার নই। নিজ গ্রামের বাড়ীতেই ভোটার হয়েছিলাম আজ থেকে ১০ বছর আগে। ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকলেও ভোটারটা বাড়িতেই হয়েছিলাম ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। পরে অবশ্য আর সেটা ট্রান্সফার করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়নি।
এবার একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ছিল ৩০ ডিসেম্বর। রবিবার। ভোট দিতে যাবো এমন মানসিকতা আগেই ছিল তবে কতটা যেতে পারবো, কতটা ভোট দিতে পারবো, সেই অনিশ্চয়তাও ছিল ষোল আনা। ঢাকায় পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়েই একচেটিয়া ক্ষমতাসীন দলের প্রচার প্রচারণা আর বিরোধী দলের নূন্যতম উপস্থিতিও না দেখায় একটু হতাশাও ছিল মনে।
সব আশঙ্কা আর হতাশাকে কবর দিয়ে ২৮ তারিখ বাড়ির উদ্দেশ্যে গাবতলীতে চলে গেলাম। একেবারেই স্বাভাবিক টার্মিনাল। অন্য সব দিনের মতই। কাউকেই বাধা দেয়া হচ্ছে তেমনটা মনে হলোনা। স্টেশনেও বাড়তি আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যও চোখে পড়লোনা। গিয়েই বাস পেলাম আর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
বাস থেকে যখন নিজ শহরে নামলাম, সবকিছুকে খুব নীরব মনে হলো। দুদিন পর নির্বাচন তেমন কোন আবহ চোখে পড়লোনা। এলাকায় গেলাম। আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা হলো। নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন বাড়তি উচ্ছ্বাসও দেখতে পেলাম না। খবর পেলাম, সেখানেও একচেটিয়া নৌকার প্রচারণা। বিএনপির প্রার্থীকে দেখা গেছে, কম বেশী পোস্টারও চোখে পড়লো। সভা-সমাবেশও হয়েছে বলেই জানতে পারলাম। কিন্তু সবারই মনে ভয়-আশংকা; নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তো?
পরের দিনও একই অবস্থা। মোটর বাইক চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও সরকারী দলের ক্যাডারদেরকে দিব্যি বাইকের প্রদর্শনী করতে দেখলাম। পুলিশকেও দেখলাম প্রকাশ্যে সরকারী দলের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে। আমি কোথাও বিরোধী দলের কাউকে দেখতে পেলাম না। যেখানে সরকারী দলের লোকেরা মহড়া করে বেড়াচ্ছে সেখানে এরা ৪/৫ জন একসাথে চায়ের দোকানে বসতেও ভয় পাচ্ছে।
নিশ্চিত ধানের শীষের ভোটার-এমন অনেককেই দেখলাম ভোট দিতে আগ্রহী নয়। তাদেরকে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা একটাই কথা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে আস্থা পাচ্ছিনা। নির্বাচনী কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরতে গেলাম। ধানের শীষের কোন ক্যাম্প দেখতে পেলাম না। নৌকার একাধিক ক্যাম্প চোখে পড়লো। কেমন যেন একটা ভীতিকর পরিবেশ। জানতে পারলাম, কয়েকদিন আগে অন্য সব জেলার মত এই জেলা শহরেও বিজিবি নেমেছে। তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের অনেকের নাম আছে। জানতে চাইলাম, সেটা কিসের তালিকা। উত্তরে জানতে পারলাম, সেই তালিকা ধরে ধরেই নাকি বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমি যে এলাকার ভোটার, সেখানে বিএনপির এক নেতাই বিরোধী দলের প্রার্থী। তাই সেখানে জামায়াত-শিবির তুলনামুলকভাবে একটু কম হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রশ্ন করলাম, আর্মির ভুমিকা কেমন? উত্তরে জানালো, যে আর্মির খারাপ-ভালো কোন রকম ভুমিকাই নেই।
আমি জানতে চাইলাম, আমি যে ভোট দেবো, আমার ভোটার সিরিয়াল কত? কেউ উত্তর দিতে পারলোনা। বললো, ধানের শীষের কেউ তো স্লিপ দিতে আসেনি। স্লিপ নিতে চাইলে নৌকার কাছ থেকেই নিতে হবে।
এরই মধ্যে শিবিরের একজন কোথা থেকে যেন ভোটার লিস্ট খুঁজে নিয়ে আসলো। সেখান থেকে আমার নাম খুঁজে পেলাম। আমরা সেই তালিকা ধরে গোটা সন্ধা থেকে রাত পর্যন্ত এলাকার আরো অনেকের নাম খুঁজে বের করলাম। অনেক আত্মীয়ের নামও বের করলাম। তাদেরকে ফোন দিয়ে দিয়ে ভোটার নাম্বার জানিয়ে দিলাম। যারা আমাদের এই সোর্সের কথা জেনে গিয়েছিল তারা ঠিকই ফোন দিচ্ছিলো। কিন্তু এর বাইরেও কয়েক হাজার ভোটার ছিল, যারা হয়তো এই তালিকাও পায়নি, স্লিপও পায়নি। তাই ভোট দেয়ারও আর সাহস পায়নি।
এরই মাঝেই একজন খবর নিয়ে আসলো, রাত ৭.৩০ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে অবস্থান নিয়েছে। আমরা ইন্টারনেট না থাকায় অফ লাইনেই আমাদের জেলার আরো বেশ কয়েকটি উপজেলার ভোটকেন্দ্রের খোঁজ নিলাম। দেখলাম সেখানেও একই অবস্থা। আমাদেরই কিছু বন্ধু বান্ধব যারা ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করে। তাদেরকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম, ওরা কি করছে? বললো, আমাদের দুই ঘন্টার এসাইনমেন্ট আছে। তারপরই আমরা ফ্রি হয়ে যাবো।
জানতে চাইলাম কি এসাইনমেন্ট? বললো সাক্ষাতে বলবো। রাতে আসতে বললাম। রাতে সেই বন্ধুদের কয়েকজন দেখা করতে আসলো। বললো, প্রতিটি উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। তারা সবাই নিজ দায়িত্বে যার যার এলাকার সেন্টারগুলোতে জাল ভোট দিবে। বললাম, পুলিশ-বিজিবি ওরা বাধা দিবেনা? উত্তরে হেসে বললো, ওরাই তো সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে পাহারা দেবে- যাতে কেউ ডিস্টার্ব না করে। যাতে বিএনপি জামায়াতের কেউ কেন্দ্রের ধারে কাছেও আসতে না পারে।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)