অ্যানালাইসিস বিডি
দেশজুড়ে গুম-অপহরণ-খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অপহরণ-গুম বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়ই বটে। এর চেয়েও বেশি আতঙ্কের খবর, নিখোঁজ হওয়াদের স্বজনরা দাবি করছেন, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা রহস্যজনক। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই বেশিরভাগ গুমের সাথে জড়িত। এসব নিখোঁজ হওয়া ঘটনায় মামলা পর্যন্ত নিচ্ছে না থানা পুলিশ।
অ্যানালাইসিস বিডি’র অনুসন্ধানে জানা যায়, এর মধ্যে র্যাব ১৫২ জনকে, পুলিশ, ৫১ জনকে, ডিবি পুলিশ ১৫৫ জনকে, র্যাব-ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ১২ জনকে, অন্যান্য সংস্থা ৯৮ জনকে এবং বাকীদের বিষয়টা নির্দিষ্ট করা যায়নি। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে মানুষ গুম করার দৌড়ে এগিয়ে আছে র্যাব।
র্যাব যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে খুনী বানায় তাদের একটি প্রশিক্ষণের অডিও রেকর্ড সুইডিশ রেডিও গত বছর পেয়েছে। যার খুব অল্প অংশ তারা প্রচার করেছে। তারা বলেছে যে ব্যক্তি এই রেকর্ড ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারবার সে প্যানেল থেকে বের হয়ে পানি খাচ্ছিল।
অডিও রেকর্ডটিতে র্যাব কর্মকর্তা বর্ণনা করেন কীভাবে পুলিশ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। এমনকি তারা অবৈধ অস্ত্র কিনে মানুষকে খুন করে সেই অস্ত্র তার পাশেই রেখে দেয়। আসলে সাধারন মানুষ কখনো অবৈধ অস্ত্র রাখে না। কিন্ত পুলিশ যাকে হত্যা করছে তারও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের বিষয় প্রমানের জন্য, বলতে গেলে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছোড়ল, এই বক্তব্যের যথার্থতার জন্য নিহতের পাশে অস্ত্র রেখে দেয়া হয়।
দুইঘণ্টাব্যাপী এই গোপন রেকর্ডিং খুবই স্পর্শকাতর। আর র্যাব যে হত্যা এবং জোরপূর্বক গুম করে এই বিষয়টি এই কর্মকর্তা তার বক্তব্যে বার বার উল্লেখ করেন।
গুমের ক্ষেত্রে তিন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে থাকেন-
(১) টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অপহরন
(২) তাকে হত্যা করা
(৩) তার লাশ চিরতরে গুম করে ফেলা।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঐ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আরো বলেন, কোন লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে তারা লাশের সাথে ভারি ইট বেঁধে দেয়। সেই কর্মকর্তা আরো কথা বলে যা অনেকেটা সিনেমার মত- যেসব অফিসার এই ধরনের অপারেশনে যায়,তারা অনেকে নিখুঁতভাবে এই কাজ করে। এটাও সত্য গুম এরপর হত্যা, এই ধরনের কাজে সব পুলিশ দক্ষ না। তাই এই ধরনের অপারেশনে কোন প্রকার ক্লু বা সামান্য চিহ্নও যাতে না থাকে, এমনকি আমাদের আইডিকার্ড, আমাদের গ্লাভস পরতে হয় যাতে আংগুলের ছাপ পাওয়া না যায়। এমনকি জুতার মধ্যেও আলাদা আবরন লাগানো হয়। পুরো কথোপকথনটি অ্যানালাইসিস বিডিতে প্রকাশিত হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলতি বছর ১২ জুলাই আয়োজিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালের পর বিভিন্ন সময় বিএনপির নিখোঁজ হওয়া ৫০০ নেতা-কর্মীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য অনুষ্ঠানে বিএনপি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের হারিয়ে যাওয়া ২৯ নেতা কর্মীর তালিকা প্রকাশ করেছে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ গুম হওয়ার বেশ কিছু দিন পর তাকে ভারতের শিলংয়ে উদ্ধার করা হয়। কে বা কারা তাকে সেখানে রেখে আসে। তিনি প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় ছিলেন। বর্তমানে ভারতে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশের একটি মামলা মোকাবেলা করছেন। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছেন বাংলাদেশের র্যাব তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যেতে। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার একজন সাক্ষীর ব্যাপারেও এমন ঘটনা ঘটেছে।
সুখরঞ্জন বালি নামে এক সাক্ষীকে ডিবি পুলিশ একেবারে প্রকাশ্যে একটি সাদা গাড়িতে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। এর বহুদিন পর তাকে পাওয়া যায় ভারতের দমদম কারাগারে। ভারতীয় আদালত তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ১১০ দিনের কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উপরের নির্দেশে তার শাস্তির মেয়াদ শেষ হলেও তাকে ছাড়া হয়নি।
এমন ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। অ্যানালাইসিস বিডির জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে এদেশে রাজনৈতিক গুমের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW) জড়িত। তাদের মর্জি মতো এদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষভাবে ডিবি ও র্যাব বিরোধীদলীয় রাজনৈতিকদের গুম, ক্রসফায়ার ও গ্রেপ্তার করা হয়।