অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও স্বনামধন্য দৈনিকে একটি খবর দেখা গেছে। আর সেটি হলো মার্কিন কংগ্রেসে নাকি বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিল পাস হয়েছে।
জামায়াত নিয়ে মিডিয়াগুলোর প্রচারনা বা অপপ্রচার নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার যেহেতু খোদ মার্কিন কংগ্রেসকেই এই প্রচারনার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে তাই বিষয়টা নিয়ে একটু অনুসন্ধান করা যাক। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষত ফেসবুকে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির এই প্রসংগে ট্রলিংট বিষয়টা নিয়ে সাধারন মানুষের কৌতুহল বাড়িয়েই তুলছে-এতে সন্দেহ নেই। বলাই বাহুল্য বাংলাদেশে এখন কোন মিডিয়ায় কোন নিউজ হলে তা গণহারে আরো বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় একইভাবে প্রকাশিত হয়। যাকে এখন সিন্ডিকেট নিউজ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। যেমন:
১লা ডিসেম্বরের ডেইলী স্টারের বাংলা সংস্করনের ‘জামায়াত-শিবির ও হেফাজত স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি: মার্কিন কংগ্রেস’ শীর্ষক নিউজে বলা হয়: জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও হেফাজতে ইসলামকে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে এসব গোষ্ঠীকে থামাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে এক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
সময় টিভির সংবাদের শিরোনাম ছিল: জামায়াত-শিবির-হেফাজত সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা বন্ধে মার্কিন কংগ্রেসে বিল
৩০ নভেম্বরের দৈনিক কালের কন্ঠের সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘মার্কিন কংগ্রেসে জামায়াত-শিবির রুখে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিল’। এতে বলা হয় বাংলাদেশের জামায়াত-শিবিরকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র-শিবিরকে দেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য চলমান হুমকি উল্লেখ করা হয়েছে বিলটিতে।
৩০ নভেম্বরের ঢাকা টাইমসের সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জামায়াত-হেফাজত নিষিদ্ধ চেয়ে মার্কিন কংগ্রেসে বিল’
একইভাবে ১ ডিসেম্বরের বাংলা নিউজের এ সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম ছিল জামায়াত-শিবির রুখে দেওয়ার আহ্বানে মার্কিন কংগ্রেসে বিল।
এই খবরসহ বিডিনিউজ ২৪ এর রিপোর্টের হেডলাইন: “Bill against Jamaat, Hifazat, other radical groups in Bangladesh placed in US Congress”
খবরগুলোতে বলা হয়েছে গত ২০ নভেম্বর কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে বিলটি উত্থাপন করেছেন ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাংকস। এখানে উল্লেখ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি কংগ্রেস সদস্যের জন্য সরকারীভাবে আলাদা আলাদা ওয়েবসাইট পরিচালনা করা হয়। জিম ব্যাংকসের নামেও ওয়েবসাইট রয়েছে। কিন্তু তার ওয়েবসাইটে তার উত্থাপিত বিলটি নিয়ে কোন কথাই নেই।
শুধু তাই নয়, ওয়েবসাইটে আরো দেখা যায়, জিম ব্যাংকস সর্বশেষ বিল উত্থাপন করেছেন গত ২৭ নভেম্বর। তার আগেরটি ২৪ অক্টোবর। কিন্তু মাঝের ২০ নভেম্বরে তিনি কোন বিল উত্থাপন করেছেন বলে সেখানে বলা হয়নি। আর যে দুটো বিলের কথা বললাম কোনোটাই বাংলাদেশ সম্পর্কিত কোনো বিল নয়। এমনকি তার সাইটে সার্চ করার যে অপশন আছে সেখানেও সার্চ দিয়েও বাংলাদেশ-সম্পর্কিত বিল পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের গনমাধ্যমগুলো বলছে যে, এই বিলটিকে কো-স্পন্সর করেছেন হাওয়াই রাজ্যের কংগ্রেসম্যান তুলসি গ্যাবার্ড। অথচ তুলসী গ্যাবার্ডের সাইটেও সেই বিলটা নেই। তার শেষ উত্থাপিত বিল ১৬ নভেম্বর।
আচ্ছা যদি সাইটে এ ব্যপারে তথ্য থাকতো তাতেই বা কি হতো। যেটা আসলে জানার বিষয় সেটা হলো, এটা কি বিল, কিংবা আদৌ এটা কোন বিল কিনা কিংবা এই বিলের প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া আসলে কি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মুলত মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে বেশ কয়েক ধরনের বিল উত্থাপন করার সুযোগ রয়েছে। এখানে হাউজ বিল বলে এক ধরনের বিল আছে যাকে এইচ আর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে জিম ব্যাংকস যেই কথিত বিলটা উত্থাপন করেছেন তাহলো এইচ.রেস অর্থাৎ হাউজ সিম্পল রিজোলিউশন। হাউজ সিম্পল রিজোলিউশন হলো অনেকটা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দেয়া ধন্যবাদ প্রস্তাব বা শোক প্রস্তাবের মত একটি প্রস্তাবনা। বাংলাদেশে যেমন বরেন্য কেউ মারা গেলে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করে সবাইকে জানানো হয়, কিংবা সরকারের শীর্ষ কোন ব্যক্তি কোন আন্তর্জাতিক পদক পেলে তাকে ধন্যবাদ প্রস্তাব দিয়ে সবাইকে অবহিত করা হয় এই হাউজ সিম্পল রিজোলিউশন বিষয়টাও অনেকটা তেমনই। কংগ্রেসে যে কেউ নিজস্ব কোন মতামত দিতে চাইলে তাকে হাউজ সিম্পল রিজোলিউশন উত্থাপন করা হয়। এটা ব্যক্তির মত হতে পারে। কিন্তু যেভাবে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো এই রিজোলিউশনটাকে কংগ্রেসের বিল হিসেবে উপস্থাপন করেছে তা গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারকেও হার মানিয়েছে। কংগ্রেসের সাথে এই হাউজ সিম্পল রিজোলিউশনের কোন সম্পর্কই আসলে নেই।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালে অনুরূপ একটি বিল মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিতে জমা দিলে তা পরবর্তীতে বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়। বাছাই কমিটি বিলের তথ্য যাচাই করে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য পাওয়ায় বিলটা নিয়ে আর অগ্রসর না হয়ে বরং তাৎক্ষনিকভাবেই তা বাতিল করে দেয়। ফলে বিলটি পরবর্তীতে আর আর কংগ্রেসে উত্থাপিতই হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন বছর পর ২০ নভেম্বর ২০১৮ জিম ব্যাংকস কর্তৃক একই ধরনের বিল কংগ্রেসে উত্থাপনের উদ্দেশ্যে কমিটিতে জমা দেয়া হয়। এবারের এই বিলে ৫৩৪ জন কংগ্রেসম্যানের মধ্যে মাত্র একজন কংগ্রেসম্যান সমর্থন করেছে। ফলে এবারেও বিলটি ২০১৫ সালের মতই ডাস্টবিন ভাগ্য বরন করতে যাচ্ছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আশংকার কথা দুটো। এক. বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে এই ধরনের বিল কেন নিয়ে আসা হলো? আর দুই. বিলটিকে নিয়ে নিজেদের মত করে এদেশীয় মিডিয়াগুলোর মিথ্যাচার। দেশ ও গনতন্ত্রের জন্য ভাল হতো যদি মিডিয়াগুলো এই বিলটিকে অপপ্রচার না করে বরং অনুসন্ধান করতো যে নির্বাচনের আগে কোন দলের লবিষ্টরা কাজ করে এবং কার কার টাকার বিনিময়ে একজন কংগ্রেসম্যানকে দিয়ে এই ধরনের একটি বিল নিয়ে আসা হলো। আফসোস, মার্কিন কংগ্রেসে এই ধরনের একটি বিল বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং আভ্যন্তরীন স্বার্থের জন্য কতটা হুমকি হয়ে উঠতে পারে আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেই সত্যটা উপলব্ধি করতে বরাবরের মতই ব্যর্থ হলো। নিছক জামায়াত বিরোধীতার কৌশলের কারনে মিডিয়াগুলো সিন্ডিকেটেড উপায়ে যে মিথ্যাচার চালালো তা দেশের জন্য কখনোই শুভ ফল বয়ে নিয়ে আসবেনা।