অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
টানা ১০ বছরের ক্ষমতার শেষ মুহুর্ত অতিক্রম করছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এই সময়ে দুর্নীতি, লুটপাট আর অপকর্মে বিগত সব সরকারকে হার মানিয়েছে তারা। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আলোচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অসংখ্য শীর্ষস্থানীয় নেতা। দলের একজন এমপি বা মন্ত্রীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের রেশ না কাটতেই অন্য একজন একই ধরনের ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। এরকম আলোচিত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য।
শাজাহান খান:
নৌ পরিবহন সেক্টরে দুর্নীতি, পরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, ষড়যন্ত্রমূলক পরিবহন ধর্মঘট, একাধিকবার ধর্ম অবমাননা ও তার উপর মুসল্লিদের জুতা নিক্ষেপের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময়জুড়েই আলোচিত ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিতর্কিত মন্তব্যসহ নানা অপকর্মে আলোচিত এই মন্ত্রী।
আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী:
ধর্ম ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে করা মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্য গত দুই বছরে সরকারকে সব থেকে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ওই ঘটনার জের ধরে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। পরে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে তাকে বহিষ্কারের পাশাপাশি তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলের জন্য স্পিকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। পরে অবশ্য তিনি নিজেই সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ঘটনার জের ধরে লতিফ সিদ্দিকীকে জেলেও যেতে হয়।
মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন:
গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। কথা না শোনায় পিস্তল দিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের পায়ে গুলি করেন। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনার পর এই সংসদ সদস্যের নামে মামলা দায়ের করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই সংসদ সদস্য গ্রেফতারও হন। পরে অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শর্তে মাস খানেক পর মুক্তি পান তিনি। গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে তার নিজ বাসভবনে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। পরে হত্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় স্থানীয় জাপা নেতা আব্দুল কাদিরকে।
এমপি আবদুল লতিফ:
চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গার এমপি আবদুল লতিফ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ফটোশপের মাধ্যমে ‘নিজের শরীরের অংশের’ সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুখমণ্ডল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এহেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হয়েছিল খোদ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই।
আমানুর রহমান খান রানা:
জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে টাঙ্গাইল ৩ আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার বিরুদ্ধে। নিজ দলের নেতাকে হত্যার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলাও চলছে।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া:
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় নেপথ্যে ভূমিকা পালনের অভিযোগ ওঠে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এমপির বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তার মেয়ের জামাই লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এই সেভেন মার্ডারের ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও এ ঘটনায় দলের ভেতরে এবং সরকারে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
এছাড়া জরুরি অবস্থার সরকারের সময়কালে দুর্নীতি মামলায় উচ্চ আদালতে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ১৩ বছরের সাজা বহাল থাকে। পরে অবশ্য আপিল বিভাগ থেকে ওই রায় স্থগিত করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি তার ছেলে রনি চৌধুরীর তিনটি ইয়াবা কারখানার সন্ধান পাওয়া গেলে আবারও আলোচনায় উঠে আসেন মায়া।
ওবায়দুল কাদের:
সড়ক পরিবহন সেক্টরের অনিয়ম দেখতে রাস্তাঘাটে নেমে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসা ওবায়দুল কাদের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন তার ‘কাউয়া’ তত্ত্বের কারণে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চুমু প্রসঙ্গ, বিরোধীদল প্রসঙ্গে নানা বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে আলোচনার তুঙ্গে থাকেন ওবায়দুল কাদের।
হাছান মাহমুদ:
জলবায়ু তহবিল লোপাটের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। যেকোনো ঘটনায় জামায়াত বিএনপি জামায়াতকে হাস্যকরভাবে জড়িয়ে বরাবরই খ্যাতিলাভ করেছেন আওয়ামী লীগের অঘোষিত মুখপাত্রখ্যাত হাছান মাহমুদ। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার জন্যও বিএনপি জামায়াতকে অভিযুক্ত করে পুরো দেশবাসীর হাসির পাত্র হন তিনি।
মাহবুবুল আলম হানিফ:
কথায় কথায় জামায়াত বিএনপিকে দোষারোপ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও নির্বাচনী হলফনামায় অভাবনীয় আয়ের উৎস মাছ চাষ দেখিয়ে আলোচনায় এসেছেন আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম:
বিরোধী দলকে হুমকি ধামকি দিয়ে বিখ্যাত নাসিম তার রাগের কারণে পাগলা নাসিম বলেও পরিচিত। স্বাস্থখাতে দুর্নীতি অনিয়ম ও সম্প্রতি তার ছেলের আমেরিকায় বাড়ি বানানোর খবরে আলোড়ন তুলেছে।
ম খা আলমগীর:
রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় “বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীরা পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছে” কথা বলে ভাইরাল হন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর। সম্প্রতি ফার্মার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।
নুরুল ইসলাম নাহিদ:
সৃজনশীল পরীক্ষা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভয়াবহ দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস ও সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আলোচিত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান:
হজ্জ ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, ছেলে ও আত্মীয়দের খুনখারাবিসহ বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে সমালোচিত হন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান।
সাহারা খাতুন:
বেপরোয়া মন্তব্যসহ নানা কাজের জন্য আলোচিত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। ২০১২ সালে সাগর রুনী হত্যার পর ৪৮ ঘন্টায় আসামিকে ধরার কথা বললে আজও শেষ হয়নি সেই তদন্ত প্রতিবেদন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত:
বর্তমান সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কথায় কথায় রাবিশ, বোগাশ, ননসেন্সসহ বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সরকারকে কয়েক দফায় বিব্রত হতে হয়েছে। এছাড়াও শেয়ারবাজার ধস, ফটকাতত্ত্ব ও জাতীয় বেতন স্কেল নিয়ে টালবাহানা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও সেশন ফি’র ওপরে ভ্যাট আরোপ করেও তুমুল সমালোচিত হন তিনি।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন:
ভয়ভীতি দেখিয়ে হিন্দুদের সম্পত্তি কম দামে কেনার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নামে। এছাড়াও পারিবারিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে রাজাকার হিসেবেও তার কুখ্যাতি রয়েছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত:
রেলের দুর্নীতি, টাকার বস্তাসহ তার পিএস আটকের ঘটনাসহ নানা বিতর্কিত ও ব্যাঙাত্মক মন্তব্যের কারণে আলোচনায় থাকতেন প্রয়াত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
ডা. দীপু মনি:
হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন কারণে অকারণে রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশ সফরের রেকর্ড ও দেশের তুলনায় বিদেশে বেশি থাকায় খবরের শিরোনাম হন দীপু মনি।
মতিয়া চৌধুরী:
শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ডুগডুগি বাজানোর মন্তব্যের কারণে বিখ্যাত ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকারের বাচ্চা বলে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম:
খাদ্র ও বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, আমদানিতে অনিয়ম ও পঁচা গম ক্রয়ের ঘটনায় ব্যপকভাবে সমালোচিত হন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়:
সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকি ও অস্ত্রসহ উত্তরার একটি বাড়িতে হামলা চালাতে গিয়ে সমালোচিত হন যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু:
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর স্ত্রী ও সন্তানদের অন্যের জমি দখল ও লাগামছাড়া অপকর্মের জন্য মন্ত্রী নিজ এলাকার দলের লোকদের থেকেও এখন বিচ্ছিন্ন। স্কুল বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ রাজপথে দাঁড়িয়ে রেখে ভূমিমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শাহরিয়ার আলম আলোচনায় আসেন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক:
দুর্নীতি, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুন্ডাবাহিনী নিয়ে ভিসির বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগসহ নানা অভিযোগ রয়েছে নানকের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খানের সমর্থকদের ও নানক সমর্থকদের সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়। এসব কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাননি বলেও বলা হচ্ছে।
জুনায়েদ আহমদে পলক:
নিজের ও স্ত্রীর নামে বিপুল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ রয়েছে সর্বকনিষ্ট এমপি বলে পরিচিত জুনায়েদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে।
তারানা হালিম:
অকারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন তারানা হালিম।
এমপি বদি:
ইয়াবা কারবারের অভিযোগে বহুল বিতর্কিত কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া আসনের এমপি আবদুর রহমান বদি। দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসার মামলায় সাজাও খেটেছেন।
নিজাম উদ্দিন হাজারী:
এক সময়কার ‘কেউটে সন্ত্রাসী’ থেকে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। অস্ত্র মামলায় জেল খেটে বের হয়ে রাতারাতি বদলে নেন নিজেকে। ফেনীর এক সময়কার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জয়নাল হাজারীর হাত ধরে রাজনীতির মাঠে আসেন। এরপর ফেনীর নিয়ন্ত্রণ নেন নিজের হাতে।
চিফ হুইপ আসম ফিরোজ:
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও পটুয়াখালী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ আ স ম ফিরোজ সরকারিভাবে তাঁর নামে একটি বাংলো ও একটি অফিস থাকার পরও সংসদ সদস্য ভবনে তিনি আরও সাতটি বাসা নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
এছাড়াও পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল, মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল, আসাদুজ্জামান খান কামাল, পটুয়াখালী-৪ আসনের মাহবুবুর রহমান, পিরোজপুর-১ আসনের একেএমএ আউয়াল, ভোলা-৩ আসনের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সিলেট-৩ আসনের মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস মোল্লা, দিনাজপুর-২ আসনের তাহজিব আলম সিদ্দিকী, নীলফামারী-৩ আসনের গোলাম মোস্তফা, খুলনা-৬ আসনের অ্যাডভোকেট নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন এমপি বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে বিতর্কিত হন।