অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি হয়ে বিছানায় অসম্ভব যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন একজন তরুন। তার নাম আতিকুর রহমান ভুঁইয়া। তাকে কয়েকদিন আগে একটি অটো রিক্সা চুরির দায়ে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। আর এখন সে বার্ণ ইউনিটে ভর্তি। তার নড়ার মত কোন অবস্থাই নেই। তবুও তার পাশে আরো দুজন পুলিশ পাহারায়। আতিকের ডান পায়ে গুলি করা হয়েছে। আর তার শরীরের অনেক অংশ আগুনে ঝলসে গেছে।
কিন্তু আতিকুরের আসলে হয়েছিল কি? পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে তার তো থানায় বা জেলে থাকার কথা। সে বার্ণ ইউনিটে পড়ে আছে কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরে যা জানা গেলো সেটাও খুব মর্মান্তিক। আতিকুরের বাবা আব্দুল হান্নান ভুইয়া জানান, গত ১১ নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শিবপুর থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে চারজন সাদা পোশাকের পুলিশ লালপুর গ্রামে সিএনজিতে চড়ে তাদের বাসায় যায়। তারা বাসা থেকেই আতিকুরকে তুলে নিয়ে আসে এবং পরিবারকে জানায় যে আতিকুরের বিরুদ্ধে অটো রিকশা চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আতিকুরের বাবা সেদিন সন্ধ্যায় থানায় যান এবং পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ১০০০ টাকা দিয়ে অনুরোধ করেন যাতে আতিককে নির্যাতন করা না হয়। কিন্তু পরের দিন সকালে যখন তিনি আবার থানায় যান তখন গিয়ে দেখেন গরম পানি মেরে আতিকের শরীরকে এরই মধ্যে ঝলসে দেয়া হয়েছে। আতিকুর তার বাবাকে জানায়, তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি নেয়ার জন্য পুলিশ সারা রাতই ওর উপর নির্যাতন চালিয়েছে।
নির্যাতনের গল্প এখানেই শেষ নয়। আতিকুরকে লক আপ পরিয়ে দুই রাত সেভাবেই থানায় ফেলে রাখা হয়। ১৪ নভেম্বর চোখ বাঁধা অবস্থায় আতিককে থানা থেকে বের করে অজ্ঞাত এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার পায়ে গুলি করা হয়। ১৫ নভেম্বর সকালে আতিকুরের বাবাকে শিবপুর থানা থেকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, তার ছেলের পায়ে আঘাত লেগেছে এবং তাকে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়ে তিনি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে তার সন্তানকে এই অবস্থায় দেখতে পান। আতিকের শরীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৬ নভেম্বর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়।
আতিকুরের বিরুদ্ধে পুলিশের এই আচরন যে কোন বর্বরতাকেও যেন হার মানায়। আতিক কি আসলেই অপরাধটি করেছে নাকি করেনি, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু কোন অবস্থায়ই একটি স্বাধীন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তার নাগরিকদের সাথে এই ধরনের অন্যায় আচরন করতে পারেনা।
শিবপুর থানা পুলিশের ওসির সাথে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আতিকুরের বাবার অভিযোগকে এড়িয়ে যান এবং বলেন, আতিকুরকে গ্রেফতার করার সময়ই তার সাথে পুলিশের গুলি বিনিময় হয় এবং এক পর্যায়ে আতিকের পায়ে গুলি লাগে।
উল্লেখ্য থানায় থাকা অবস্থায় আতিকের ঝলসানো দেহটি শুধু যে তার পিতাই দেখেছিল তা নয়। স্থানীয় বাঘাবো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তরুন মৃধাও তাকে থানায় একই অবস্থায় দেখতে পান। পুলিশের বিরুদ্ধে আতিকুরের পরিবারের অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর।
পুলিশের বর্বরতার ঘটনা এরকম একটা নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুম বানিজ্য ও হত্যার পরিমানও আশঙ্কা জনকভাবে বেড়েছে। যশোরের বিএনপির এক সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রার্থী আবু বকর আবু ঢাকায় মনোনয়ন নিতে এসে অপহৃত হয়ে যান। তার পরিবারের কাছ অজানা উৎস থেকে ফোন আসে। সেই ফোনের নির্দেশনা মোতাবেক পরিবার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধও করা হয়। তারপরও দুদিন পর বুড়িগঙ্গায় ঠিকই লাশ ভেসে ওঠে আবুর। পুলিশ দুনিয়ার সবার নাম্বার ট্রাক করে তাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারলেও আবুর অপহরনকারীদের ফোনও ট্র্যাক করা হয়না, তাদেরকে খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হয়না। কেননা এর সাথে তাদের বাহিনীর লোকেরাই জড়িত। পরের দিন যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এই হত্যার ব্যপারে মুখে ভেংচি কেটে মন্তব্য করেন, ডাল মে কুচ কালা হ্যায় আর যখন গোটা হত্যাকান্ডটিকে বিএনপির আভ্যন্তরীন কোন্দলের ফলাফল হিসেবে চিত্রায়িত করেন তখন বোঝা যায় মানবতাকে আরো একবার কিভাবে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
একইভাবে এয়ারপোর্টের প্রবেশ মুখ থেকে অপহৃত হয়েছেন দক্ষিন কোরিয়ার পিএইচডি অধ্যায়নরত ছাত্র এনামুল হক মনি। তিনি বিমান বন্দরে ঢোকার সময়ও তার পরিবারের সাথে কথা বলেছেন। অথচ তারপর থেকে তার মোবাইল অফ। অজ্ঞাত নাম্বার থেকে পরিবারকে ফোন দিয়ে জানানো হয় এনামুলকে তারা অপহরণ করেছে এবং মুক্তিপন হিসেবে বেশ বড় অংকের টাকাও চাওয়া হয়। যারা বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন তারা জানেন এয়ারপোর্টে ঢোকার মুখেই পুলিশের কয়েকটি চেকপোস্ট আছে। সাধারন যারা যাত্রী তারাই নানাভাবে তল্লাশীর নামে হেনস্তার স্বীকার হচ্ছেন প্রায়শই। গাড়িতে নির্দিষ্ট ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার ছাড়া অন্য কোন আত্মীয় থাকলে তাকেও নামিয়ে দেয়া হচ্ছে অহরহই। এরকম একটি জায়গা থেকে একজন মানুষকে কিভাবে অপহরন করা সম্ভব হয় যদি না তাতে পুলিশের সম্পৃক্ততা না থাকে।
এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের আরো অনেক জায়গাতেই অনেকের সাথেই ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। আর এই অভিযোগগুলো দেশের আইন শৃংখলা বাহিনীগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দায়সারা মন্তব্য করে পুলিশ সদস্যদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে বরং অভিযোগগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।