অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মোহাম্মাদ বিন সালমানকে নিয়ে বিতর্ক চলছে তার ক্রাউন প্রিন্স পদে নিয়োগের পর থেকেই। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তুরস্ক সরকার মার্কিন প্রশাসনকে জানিয়েছে যে, তাদের কাছে এমন কিছু অডিও ও ভিডিও বার্তা আছে যা দিয়ে বোঝা যায় যে, ওয়াশিংটন পোস্টে কর্মরত সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে গত সপ্তাহে ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে।
খাসোগি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্টের ভার্জিনিয়াতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে বসবাস করছিলেন। সৌদি বর্তমান রাজ পরিবার এবং এর মূল ক্রীড়নক মোহাম্মাদ বিন সালমানের তিনি একজন সমালোচক হিসেবেও পরিচিত।
এই সপ্তাহের শুরুতে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তুরস্ক প্রশাসনের বেশ কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায় যে, সৌদি রাজ দরবারের আদেশের ভিত্তিতেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মাদ বিন সালমান ব্লুমবার্গ পত্রিকাকে বলেছেন যে, আমাদের লুকানোর কিছুই নাই।
২০১৫ সালে মোহাম্মদের বাবা, সালমান বিন আব্দুল আজীজ আল সৌদ সৌদি আরবের বাদশাহ নিযুক্ত হন। তার আগ পর্যন্ত কেউই সেভাবে মোহাম্মাদ বিন সালমানের নাম শুনেনি। বাদশাহ সালমানের বয়স এখন ৮২। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি মোহাম্মাদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স বা পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে নির্ধারন করেন। এরপর থেকেই মোহাম্মাদ বিন সালমান আলোচনায় চলে আসেন। তিনি দেশটিতে দুর্নীতি বিরোধী একটি অভিযানও পরিচালনা করেন যার ভিত্তিতে সৌদি সরকার, রাজ পরিবার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের অনেককেই সেসময় আটক করা হয়।
মোহাম্মাদ বিন সালমানের উত্থান যেভাবে হলো:
মোহাম্মাদ বিন সালমান (এমবিএস নামেও পরিচিত) জন্ম নেন ১৯৮৫ সালের ৩১ আগষ্ট। তার পিতা হলেন বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমান আর মায়ের নাম প্রিন্সেস ফাহদা বিনতে ফালাহ বিন সুলতান। প্রিন্সেস ফাহদা ছাড়াও বাদশাহ সালমানের আরো চারজন স্ত্রী আছেন।
প্রিন্স মোহাম্মাদ বড় হয়েছেন রিয়াদের ওয়ালেদ কমপ্লেক্সে। সেখানে তার মা, আরো ৫ ভাই এবং ৫০ জন স্টাফ বসবাস করতেন। যার মধ্যে আছে বেশ কয়েকজন ভৃত্য, বাবুর্চি, গাড়িচালক এবং অন্যন্য। তার পিতা সালমান তখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক দফা গৃহযুদ্ধের পর ১৯৩২ সালে ইবনে সাউদ গোটা সৌদি রাজ্যকে আল সৌদ পরিবারের আওতায় নিয়ে আসেন।
প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান তার ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়েছেন কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের উপর। সেখানে তিনি শীর্ষ ১০ ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি তার পিতার বিশেষ উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তার আগ পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছেন। সরকারের কিছু দায়িত্বও পালন করেছেন।
প্রিন্স মোহাম্মাদ মিস্ক ফাউন্ডেশন নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠা করেন। যার মাধ্যমে সৌদি যুবক ও বিনিয়োগকারীদেরকে নতুন নতুন সুবিধা দেয়া হতো। ২০১৩ সালে এই ফাউন্ডেশনের অনবদ্য কর্মকান্ডের জন্য ফোর্বস মিডল ইস্ট তাকে পারসোনালিটি অব দ্য ইয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করে।
২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে প্রিন্স মোহাম্মাদকে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই প্রিন্স সালমান তেহরানের উপর চড়াও হন। তিনি ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের উপর সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের আক্রমন চালান। ইয়েমেন আক্রমনের নাম দেয়া হয় অপারেশন ডিসাইসিভ স্টোর্ম।
ইয়েমেনের যুদ্ধকে সাম্প্রতিক মানব ইতিহাসের ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেখানে শুধুমাত্র ক্ষুধার কারনেই কয়েক হাজার মানুষ এরই মধ্যে মারা গিয়েছে। তাছাড়া সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে অনৈতিক বিমান হামলা চালানোর অভিযোগও তুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। অন্যদিকে হুথিরা অভিযোগ করছে সৌদি সেনারা মারাত্মকভাবে মানবাধিকারের লংঘন করছেন, জোরপূর্বক ধরপাকড় চালাচ্ছেন এবং শিশুদেরকে সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। (সূত্র: বিবিসি)
২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রিন্স মোহাম্মাদ, যিনি একই সংগে সৌদি কাউন্সিল ফর ইকোনোমিক এফেয়ার্স এন্ড ডেভেলপমেন্টেরও প্রধান, তিনি ভিশন ২০৩০ নামক একটি উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা ঘোষনা করেন। এই পরিকল্পনার মুল উদ্দেশ্য ছিল সৌদি অর্থনীতিকে বৈচিত্রময় করা এবং তেলের উপর থেকে নির্ভরতা কমানো। একই ঘোষণায় প্রিন্স মোহাম্মাদ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল তহবিল গঠনের কথা জানান। আরামকোর ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে এবং সমাজে কিছু সংস্কার সাধন করে এই তহবিল গঠন করা হবে বলে তারা জানান। (সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি)
বাদশাহ সালমান প্রথমে মোহাম্মাদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নির্ধারন করেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নিজের ছেলে মোহাম্মাদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন এবং তার হাতে অস্বাভাবিক পরিমান ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান এক ফরমান জারি করেন যার আলোকে প্রায় ২০ জন ধর্মীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবিকে গ্রেফতার করা হয়। আটককৃতরা সৌদি রাজ পরিবারের সমালোচক ছিলেন। তবে সরকারীভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে তারা বিভিন্ন বিদেশী সংগঠন বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং কাতারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন।
এর কয়েক মাস পর তিনি দুর্নীতি দমনের নামে একটি অভিযান চালান যাতে প্রিন্স মোহাম্মাদের ক্ষমতার বিষয়টি সকলের সামনে দৃষ্টিগোচর হয়। এই অভিযানে ১১ জন প্রিন্স, চারজন মন্ত্রী এবং বেশকিছু ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। (সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার)
অন্যদিকে প্রিন্স মোহাম্মাদ বেশ কিছু সামাজিক সংস্কারের উদ্যেগ নেন যার মধ্যে আছে দেশকে আধুনিকায়ন করা, নারীদের গাড়ি চালানো এবং খেলাধুলায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া।
তবে সর্বশেষ সাংবাদিক জামাল খাসোগির অপহরন ও হত্যায় প্রিন্স মোহাম্মাদের নাম আসে গত সপ্তাহে। খাসোগি প্রিন্স মোহাম্মাদের মধ্যমপন্থী ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিয়মিত কলাম লিখতেন। তুরস্ক কর্মককর্তারা জানিয়েছেন ১৫ জন সৌদি নাগরিকের একটি বিশেষ আততায়ী দল গত ২ অক্টোবর তুরস্কে আসে- যেদিনই মূলত খাসোগি নিখোঁজ হন। এই ১৫ জন মাত্র কয়েক ঘন্টা তুরস্কে অবস্থান করেন। ধারণা করা হচ্ছে সৌদি রাজ পরিবারের নির্দেশে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা খাসোগিকে হত্যা করে এবং তার দেহকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে গায়েব করে দেন।
এই ঘটনার পর মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদি প্রশাসনের সম্পর্কে বেশ বড় আকারের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। (সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার এবং নিউইয়র্ক টাইমস)