মাহমুদুর রহমান
আমার ফাঁসি চাই নামের একটা বই বাংলাদেশে এক সময় তুমুল উত্তেজনার জন্ম দিয়েছিল। লেখকের নাম মতিউর রহমান রেন্টু। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন সপরিবারে শেখ হাসিনার প্রায় সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে তার ঘোরতর মনোমালিন্যের কারন ঘটে এবং তিনি বাংলাদেশের অমিত ক্ষমতাবান এক নারীর আশ্রয় থেকে বিতারিত হন। এরপর লেখক মতিউর রহমান রেন্টুর আবির্ভাব ঘটে। ভারত ব্যতীত আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত শেখ হাসিনার দানবীয় চরিত্রের বিবরণ রেন্টুর বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। মতিউর রহমান রেন্টুকে হয়ত সুলেখক বলা যাবে না। আমার ফাঁসি চাই ছাড়া তিনি আর কোন সাহিত্য চর্চা করেছেন কিনা আমার সেটিও জানা নেই। তবে শেখ হাসিনার বিকারগ্রস্ত মানসিকতার পরিচয় পাওয়ার জন্য বইটি একটি চমৎকার দলিল হয়ে থাকবে। আপাদমস্তক ফ্যাসিস্ট এই নারী রাজনীতিকের প্রথম দফার শাসনামলে অনেক ভীরু বাঙালী মুসলমানকে লুকিয়ে চুড়িয়ে আমার ফাঁসি চাই পড়তে দেখেছি। আমিও কোন বীর পুরুষ ছিলাম না। কোন এক বন্ধুর দেয়া ফটোকপির বদৌলতেই আমার রেন্টুর লেখা বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। রেন্টু তার লেখায় দাবী করেছেন যে শেখ হাসিনা একজন ফ্যাসিস্ট (Sadist), মাদকাসক্ত, নররক্ত পিপাসু, প্রচন্ড কলহ প্রিয়, ভয়ানক হিংসুক, ইত্যাদি, ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, বই রচনার পর মতিউর রহমান রেন্টু আর বাংলাদেশে থাকতে পারেননি। অনেকটা অকালে প্রবাসেই তার জীবনাবসান ঘটেছে। যে দেশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন সেই দেশটি সম্ভবত: ফ্রান্স। তার স্ত্রী এবং সন্তান কোথায়, কিভাবে আছেন আমার জানা নেই।
রেন্টু এবং তার লেখা বইয়ের কথা আমার মনে হঠাৎ উদিত হয়নি। মালয়শিয়ার প্রবাস জীবনে বাংলাদেশের আর এক নব্য সাহিত্যিকের বই পড়তে পড়তে দীর্ঘদিন পরে রেন্টুকে মনে পড়েছে। আমি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এবং তার সাড়ে ছয়শ পাতার ঢাউস বই, A Broken Dream এর কথাই বলছি। রেন্টু লিখেছিলেন বাংলায় আর বিচারপতি সিনহা লিখেছেন ইংরেজীতে। সাহিত্যমানে দুই বইয়ের মধ্যে তেমন একটা তফাৎ নেই। ভিন্নতা অন্য জায়গায়। রেন্টু নিজেকে মহৎ কিংবা নির্দোষ সাব্যস্ত করার কোন অভিপ্রায় নিয়ে আমার ফাঁসি চাই রচনা করেন নাই। বরঞ্চ, শেখ হাসিনার মত ব্যক্তির সঙ্গে নিজের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ট সম্পর্কের অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে ফাঁসির দন্ড অভিপ্রায় করেছেন। রেন্টু নিজের অপরাধ কবুল করে মহৎ হয়ে গেছেন। আর একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি পর্বতসম কৃত অপরাধের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেও বাংলাদেশে চিরকাল বিতর্কিত হয়েই রইবেন। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে রেন্টু তেমন কোন অপরাধই করেন নি। আর বিচারপতি এস কে সিনহা একমাত্র ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সাহস দেখানো ছাড়া অপরাধের পর অপরাধ করে গেছেন। যে ব্যক্তি সমস্ত কর্ম জীবনে বিবেকহীন ভাবে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ এবং ভারতের ইচ্ছাপূরন করেছেন, তিনি কেন কর্মজীবনের বিদায় বেলায় ষোড়শ সংশোধনীকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্ট শাসকদের সাথে এমন বিবাদে জড়ালেন তার কোন যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আমি A Broken Dream এ পেলামনা। এই ব্যর্থতা লেখকের নাকি এই পাঠকের সেটি বিবেচনার ভার এস কে সিনহার জীবন চরিতের অন্যান্য পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমার সৌভাগ্য যে এস কে সিনহা এখন সাবেক হয়ে গেছেন। নইলে এই লেখার জন্য তার ভাষায় বিচারপতিদের Inherit Power খাটিয়ে আমাকে দ্বিতীয়বার আদালত অবমাননার অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে দিতেন। এবার হয়ত চরম দন্ডই শুনিয়ে ফেলতেন। তিনি যে ফাঁসির রায় শোনাতে খুব পছন্দ করেন তার প্রমান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে রেখে এসেছেন। শেখ হাসিনার একদার অতীব প্রভাবশালী পরামর্শদাতা এস কে সিনহা এখন আওয়ামী লীগের কাছে অপ্রিয় হলেও বিএনপির কাছে বেজায় প্রিয়। অনেকে বলেন বিএনপি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে এস কে সিনহা নাকি রাষ্ট্রপতিও হয়ে যেতে পারেন। বিচিত্র বাংলাদেশে সবই সম্ভব। বিএনপির নেতৃবৃন্দ বিচারপতি সিনহার সকল দুস্কর্ম কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে চান। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই নীতিতে বিশ্বাসীরা হয়ত এস কে সিনহার যাবতীয় পাপ ভুলে যেতে চাইবেন। তবে তার দ্বারা অন্যায়ভাবে দন্ডপ্রাপ্ত এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নিশ্চয়ই এই অনাচার কোনদিন ভুলবেন না।
এবার A Broken Dream এর একটিু গভীরে প্রবেশ করবার চেষ্ট করছি। পুরো বইটিতে লেখকের অভিযোগের তীর প্রধানত: বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা, আইনমন্ত্রি আনিসুল হক এবং ডিজিএফআই অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দিকে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারলেই সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে। দখলদার, ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড.গওহর রিজভীও নাকি এস কে সিনহাকে সেরকম বার্তাই বরাবর দিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার যেটুকু সমালোচনা বইটিতে আছে সেটি এস কে সিনহা নিজেকে নির্দোষ প্রমান করবার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েই করেছেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন শেখ হাসিনার সম্পূর্ন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে রীতিমত জেহাদ শুরু করে দিয়েছে তখনও এস কে সিনহা ৫৮০ পৃষ্ঠায় লিখছেন, The Prime Minister was ill-advised (প্রধানমন্ত্রীকে ভুল পরামর্শ দেয়াই হচ্ছে)। অর্থাৎ শেখ হাসিনার কোন অপরাধ নাই, স্বার্থান্বেষী মহল তাকে ভুল বুঝিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাকে এতটাই পছন্দ করেন যে, গওহর রিজভীর মাধ্যমে সংবাদ পাঠাচ্ছেন যাতে এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ না করেন!!! অথচ ২০ কিংবা ২১ সেপ্টেম্বর (এস কে সিনহা এভাবেই তারিখ লিখেছেন) জাপানে ডিজিএফআই এর একজন কর্মকর্তা তাকে পরামর্শ অথবা নির্দেশ দিচ্ছেন যে তিনি যেন বাংলাদেশে না ফিরে জাপান থেকেই অস্ট্রেলিয়া অথবা কানাডা চলে যান। বিচারপতি সিনহা শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে এতোটাই উদ্বিগ্ন থাকতেন যে ডিজিএফআই তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার পর ১৭ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ভারতের বেসরকারী টেলিভিশন, Zee News (জি-নিউজ) এর কাছে বলেছেন, ‘our judiciary is totally independent’ (আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন)। অর্থাৎ একজন প্রধান বিচারপতি সম্পূর্ন সজ্ঞানে মিডিয়ার কাছে বেমালুম মিথ্যা কথা বলছেন। এস কে সিনহার যুক্তি হলো মিথ্যা কথার মাধ্যমে তিনি নাকি দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চেয়েছেন। তাহলে তো, এত বিতর্কের সৃষ্টি না করে তার অনেক আগেই পদত্যাগ করা উচিৎ ছিল। আসল কথা হলো, তিনি তখনও আশা করছেন যে ভারত শেখ হাসিনার মত পরিবর্তন করাতে সক্ষম হবে এবং তিনিও প্রধান বিচারপতির মেয়াদ শেষ করে ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে অবসরে যেতে সক্ষম হবেন। এস কে সিনহা দেশের স্বাধীনতা, জনগনের দু:খ-কষ্ট অথবা তাদের ওপর ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণির জুলুমের কথা কখনও ভাবেননি। তার চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হয়েছে কেবল নিজের এবং পরিবারের স্বার্থকে ঘিরে। ঢাকা বিমাবন্দরে এবং সিঙ্গাপুরে সরকারী প্রটোকল না পাওয়ার দু:খে তার স্ত্রী অশ্রু বিসর্জন করলে বেদনায় এস কে সিনহার হৃদয় ভেঙে গেছে। A Broken Dream থেকেই উদ্ধৃত করছি,
“She was travelling as the wife of the Chief Justice. She noticed an officer of the High Commission in the airport, but he did not come forward to receive her. She travelled from one terminal to another at dawn as an ordinary passenger by travelling on two commuter trains. Since previously she had always traveled with official protocol she faced great consternation as a transit passenger from Singapore airport to Australia. She overcame the problems by asking unknown persons to show her the right direction at the airport.
On her arrival at Brisbane Airport, she shed tears on seeing me. I realised that she had been made to suffer. I was much angered and prayed to the Almighty that no spouse of any Chief Justice or holder of a constitutional post should ever be made to undergo such types of humiliation in future.” (Page:604)
(তিনি প্রধান বিচারপতির স্ত্রী রূপে ভ্রমন করছিলেন। হাই কমিশনের একজন কর্মকর্তাকে তিনি বিমানবন্দরে দেখতে পান, কিন্তু সেই ব্যক্তি আমার স্ত্রীকে অভ্যর্থনা করার জন্য এগিয়ে আসেন নাই। সেই ভোরে একজন সাধারন যাত্রীর মত এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে সে ছোটাছুটি করেছে এবং বিমানবন্দরে দুইবার সংযোগ ট্রেন বদল করে গন্তব্যে পৌছেছে। যেহেতু সবসময় সে প্রটোকল পেয়ে অভ্যস্ত তাই সাধারন ট্রানজিট যাত্রী হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়া পৌছাতে তার খুব কষ্ট হয়েছে। বিমান বন্দরে অপরিচিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করে তার পথ এবং সঠিক প্লেন চিনে নিতে হয়েছে। ব্রিসবেন বিমান বন্দরে পৌছে আমাকে দেখেই আমার স্ত্রী কেঁদে ফেললেন। আমি তার দু:খ এবং অপমান অনুভব করতে পারলাম। আমার প্রচন্ড রাগ হলো এবং সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করে বললাম যেন অন্য কোন প্রধান বিচারপতি অথবা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির পরিবারকে ভবিষ্যতে এমন অপমান সইতে না হয়। )
স্ত্রীর অপমান এবং কষ্টে তার স্বামীর দু:খিত হওয়াটাই স্বভাবিক। বিচারপতি এস কে সিনহার ক্রোধান্বিত হওয়া এবং মর্ম বেদনার বহি প্রকাশও অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কিন্তু, প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এবং তৎকালিন আপীল বিভাগের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারপতি এস কে সিনহার অবিচারের কারনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রীকে যেদিন অন্যায়ভাবে ক্যান্টনমেন্টের নিজগৃহ থেকে শেখ হাসিনার পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উচ্ছেদ করেছিল এব্ং অসীম বেদনায় বেগম খালেদা জিয়া যখন সাংবাদিকদের সামনে কাঁদছিলেন তখন বিচারপতি সিনহা কী বিবেকের কোন দংশন অনুভব করেছিলেন? তার অবিচারের কারনে কতজনের স্ত্রী ও সন্তান নিরাশ্রয় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাংলাদেশ ছেড়েছে সেই সংবাদ কী তিনি রাখেন? আমাকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন করলে আমার স্ত্রী হাইকোর্টে রিমান্ড বাতিলের জন্য রীট করেছিল। সেই রীট খারিজ করে হাইকোর্টের বেঞ্চ বলেছিলেন যে, আমার স্ত্রী নাকি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নন। স্বামীর উপর যুলুমে স্ত্রী সংক্ষুব্ধ না হলে কে সংক্ষুব্ধ হবে? এমন অদ্ভুত রায় তো এস কে সিনহার প্রধান বিচারপতিত্বের আমলেই হাইকোর্ট থেকে দেয়া হয়েছে। তার স্ত্রীর অপমানে ব্যথিত হয়ে তিনি সর্বশক্তিমানের কাছে অন্য কোন প্রধান বিচারপতি অথবা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিতদের পরিবারের সম্মানহানী যাতে না হয় তার জন্য প্রার্থনা করেছেন। কী আশ্চর্য্য প্রার্থনা!!! সাংবিধানিক পদের বাইরে বাংলাদেশের যে কোটি কোটি নাগরিক, তাদেরকে অপমান করা হলে এই প্রধান বিচারপতির তাতে কোন আপত্তি নেই। আমাদের সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সম অধিকারের যে কথা লেখা আছে সেটা তাহলে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার জানা নেই। অথবা জানলেও জনগনের এই অধিকারকে তিনি স্বীকার করেন না। শুধু ক্ষমতাবানদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার মাধ্যমেই এস কে সিনহার সুবিধাবাদী এবং এলিটিস্ট চেহারা ফুটে উঠেছে।
এস কে সিনহার ভাষাতেই একজন স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার অবৈধ, ফ্যাসিবাদী শাসনকে সহায়তা করতে সাবেক প্রধান বিচারপতির ভূমিকার একটি ফিরিস্তি তৈরী করা যাক।
১। বেগম খালেদা জিয়াকে আপীল বিভাগে শুনানীর সুযোগ না দিয়েই বেআইনিভাবে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ।
২। সংবিধান থেকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিলের পক্ষে রায় প্রদান। প্রায় পুরো বই জুড়ে বিচারপতি এস কে সিনহা যে বিচারপতি ওয়াহাব মিঞার সমালোচনা করেছেন তিনি কিন্তু, তত্বাবধায়ক সরকার প্রথাকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল হওয়াতেই শেখ হাসিনা অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশে গনতন্ত্র বিনাশ এবং জনগনের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরন করার সেই সুযোগ সৃষ্টিতে বিচারপতি খায়রুল হক এবং বিচারপতি এস কে সিনহার ঘৃন্য ভূমিকার কথা জাতি কোনদিন ভূলবে না।
৩। বিএনপির শাসনামলে বিরোধী দলের সদস্যদের নামে রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হলে উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তি এক প্রকার আইনী প্রথা (Legal convention) হিসেবে মান্য করা হতো। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এবং প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আগাম জামিন প্রাপ্তির সেই পথ রূদ্ধ করে চার সপ্তাহ অথবা ছয় সপ্তাহের Direction এর নিয়ম চালু করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিনত করার পথ সুগম হয়।
৪। বাংলাদেশে যাবজ্জীবন কারাদন্ড একটি সময় দ্বারা নির্ধারিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৪ বছর, জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ২০ বছর এবং এরশাদের সময়ে ৩০ বছরে মেয়াদ নির্ধারিত করা হয়। প্রধান বিচারপতি সিনহা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ ‘আমৃত্যু’ করবার এক নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন। এর ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্্রকে এক নতুন জুলুমের অস্ত্র প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হয়।
৫। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ব্যতীত প্রতিটি মামলায় এস কে সিনহা সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছেন। ২০১৭ সালের আগষ্টে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বৈঠকে এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম সরকারের পক্ষে ‘extra ordinary judgment’ দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতির প্রশংসা করেছেন। (চ্যাপ্টার ২৭)
৬। এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমের সাথে একজোট হয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দখলদার শেখ হাসিনা সরকারের সকল গন বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। A Broken Dream এর ৬ নম্বর চ্যাপ্টারে এটর্নী জেনারেলের সাথে বিশেষ সখ্যতার বিষয়টি বিচারপতি সিনহা এভাবে বর্ণনা করেছেন:
“One weekend morning Mahbubey Alam came to my official residence at Kakrail for discussion on a private matter. We were then on very good terms because of our progressive thinking. He is a thoroughly progressive-minded gentleman and has a weakness in Rabin Dra Sangeet and occasionally arranged Rabindra Sangeet programs at his residence sometimes inviting Indian singers for selected audiences.”
(একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপের জন্য মাহবুবে আলম এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকালে আমার কাকরাইলের সরকারী বাসায় এলেন। প্রগতিশীল মানসিকতার জন্য আমাদের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। মাহবুবে আলম সম্পূর্নভাবে একজন প্রগতিশীল ভদ্রলোক এবং তার রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতি দূর্বলতা আছে। মাঝে মধ্যে তিনি বাসায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসর বসাতেন এবং বিশেষ অতিথিদের জন্য ভারতীয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন।)
আমি মনে করি প্রগতিশীল প্রধান বিচারপতি এবং এটর্নী জেনারেলের সম্পর্ক নিয়ে আমার কোন মন্তব্যের প্রয়োজন পড়ে না।
৭। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এর গঠন থেকে শুরু করে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেয়া পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভূমিকা পর্যালোচনা করা হলে Code of Conduct এবং Legal Ethics ভঙ্গের দায়ে বিশ্বের সর্বত্র তিনি অভিযুক্ত হবেন। অ ইৎড়শবহ উৎবধস একজন প্রধান বিচাপতির একটি চমৎকার স্বীকারোক্তি (Confession)। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত স্কাইপ কেলেংকারিতেও তার সংযোগের কথা বিচারপতি এস কে সিনহা স্বীকার করে গিয়েছেন।
৮। তার বিরুদ্ধে সরকারের উত্থাপিত দূর্নীতির সকল অভিযোগকে তিনি বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যমূলক বলেছেন। কিন্তু, এস কে সিনহা সম্ভবত: ভুলে গেছেন যে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সহ বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুদকের সকল ভুয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত অভিযোগ ও মামলাকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে তিনি দিনের পর দিন আইনগত বৈধতা দিয়ে গেছেন। পরিবারসহ তাদের হয়রানিতে তিনি সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। নিজের বেলায় অন্য রকম ব্যাখ্যা তাই ধোপে টিকবেনা। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
৯। প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি হাইকোর্টে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী এবং এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমের পরামর্শক্রমে কেবল বেঞ্চ গঠন করেই ক্ষান্ত হন নাই, বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সুবিচার পাওয়ার পথ একে একে বন্ধ করেছেন। বিচার বিভাগকে সরকারের আজ্ঞাবহে পরিনত করেছেন। শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা আজো টিকে থাকার কারন বর্ণনায় তিনি নিজেই লিখেছেন,
“ All that was possible only due to the weakness of the opposition political party, the support of a neighboring regional super power and the judiciary’s role.”
(এ সব সম্ভব হওয়ার কারন হলো বিরোধী রাজনৈতিক দলের দূর্বলতা, প্রতিবেশী আঞ্চলিক পরাশক্তির সমর্থন এবং বিচার বিভাগের ভূমিকা।)
বিচার বিভাগের এই নতজানু ভূমিকা নিয়েই ২০১০ সালে আমি আমার দেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ওই লেখার জন্য আদালত অবমাননার মামলা হলে A Broken Dream এর লেখকই আপীল বিভােেগর পক্ষে আমার বিরুদ্ধে সাজার রায় লিখেছিলেন। তিনিও কী উপরোক্ত স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আজ আদালত অবমাননা করে ফেললেন না? তিনি কি স্বীকার করবেন যে আমার আট বছর আগের লেখায় আমি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অবস্থা সততার সাথে এবং সঠিকভাবে বর্ননা করেছিলাম? আমাকে সাজা দিয়ে তিনি এবং আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিরা সেদিন অন্যায় করেছিলেন।
আমার লেখা আর দীর্ঘ করে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে চাচ্ছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে বসে বিচারপতি এস কে সিনহা খানিকটা হলেও যে বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নতজানু বিচার ব্যবস্থা এবং ডিজিএফআই এর মুখোশ উন্মোচন করেছেন সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। বিলম্বে হলেও সাহস করে লিখেছেন যে সেনাবহিনী, বিচার বিভাগ এবং দিল্লির সহায়তার জন্যই এক দূর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রীর অবৈধ শাসন বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এই কথাগুলো বলার অপরাধেই আমার বিরুদ্ধে ১২৫টি মামলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলাম, স্বয়ং দখলদার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমাকে পাঁচ বার হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। তবে বিচারপতি সিনহাকে সমবেদনা জানাতে পারছিনা কারন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকার জন্য তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগনের কাছে এখনও ক্ষমা চাননি। বরঞ্চ, নিজেকে মহান এবং লড়াকু দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশে প্রতিদিন কত মানুষ গুম হচ্ছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কত তুচ্ছ বিষয়ে সুয়ো মোটে রুল এবং আদেশ দিচ্ছেন। কই, গত দশ বছরে প্রথমে আপীল বিভাগের প্রভাবশালী বিচারপতি এবং পরবর্তীতে প্রধান বিচাপতি এস কে সিনহা কোন আদেশ দিয়ে জুলুমের হাত টেনে ধরার তো চেষ্টা করেননি। বরঞ্চ শেখ হাসিনার সেই কাল হাতে শক্তি জুগিয়েছেন। সুতরাং বাংলাদেশের জনগন সিনহার কাছ থেকে দু:খ প্রকাশের দাবী করতেই পারে। তিনি দু:খ প্রকাশ করলে আমরা যারা অবিচারের শিকার হয়েছি তারাও তার হেনস্থার জন্য আন্তরিকভাবে সমবেদনা জানাতে পারি। কদিন আগে A Broken Dream নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি বিবৃতি মিডিয়ার অনলাইনে পড়লাম। সেখানে জামায়াতে ইসলামী বলেছে যে বিচারপতি সিনহা নাকি বিবেকের তাড়নায় এই বই লিখেছেন। এই বক্তব্যের সাথে আমি একমত হতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় মতিউর রহমান রেন্টু তার বই লিখেছিলেন। সেই জন্যেই বইয়ের নাম দিয়েছিলেন আমার ফাঁসি চাই। বিচারপতি সিনহা আত্মপ্রচারের জন্য তার জীবন চরিত রচনা করেছেন, নিজের গুনগান করেছেন। সেই লক্ষ্যে কিছুটা সফলও যে হয়েছেন তাতেও কোন সন্দেহ নেই। বিচারপতি সিহার কাছের মানুষ শেখ হাসিনা তার প্রতি এখন ভয়ানক রুষ্ট হলেও বিএনপি এবং জামায়াত পন্থী লোকেরা তার বেশ প্রশংসা করেন। আর সুশীলদের প্রিয় মানুষ তো তিনি সর্বদাই ছিলেন। তবে এই আপাত: সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। শেষ পর্যন্ত ইতিহাস সকলের অবস্থানই নির্মোহভাবে নির্ণয় করে। আমরাও অপেক্ষায় রইলাম৷
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আমারদেশ