অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের ন্যয্য দাবি কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনরতদের উপর সরকারি দমন পীড়ন সীমা ছাড়িয়েছে। ছাত্রলীগকে দিয়ে বেধড়ক মারপিট ও নির্যাতনের পর এখন পুলিশ দিয়েও তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি ছাত্রলীগের হামলায় আহতদেরকে চিকিৎসা নিতেও বাধা দিচ্ছে সরকার। সরকারের নির্দেশে হাসপাতালগুলো আহত শিক্ষার্থীদেরকে চিকিৎসা না দিয়েই বের করে দিচ্ছে।
এদিকে পর পর কয়েকদিন শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালালেও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সবসময়ই তা অস্বীকার করা হয়েছে। যদিও পত্রিকার ছবি ও টিভি চ্যানেলগুলোর ভিডিওতে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকায় হামলায় অংশগ্রহনকারীদের সশস্ত্র অবস্থার চিহ্নিত ছবি নামসহ প্রকাশিত হলেও এখন পর্যন্ত তাদেরকে গ্রেফতারের কোনো পদক্ষেপই নেয়নি পুলিশ। ছাত্রলীগের হাতুড়িপেটায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে রাবি শিক্ষার্থী তরিকুল। এই হামলায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলাও করেনি পুলিশ।
তরিকুল ইসলাম তারেককে পতাকায় থাকা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে ছাত্রলীগকর্মী জন স্মিথ। লাথি দিচ্ছে সহ-সভাপতি রমিজুল ইসলাম রিমু এবং মাঝে শোভন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের উপর পর পর দুইদিন সশস্ত্র হামলা চালানোর পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি) কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি নিয়ে দুইদিন হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
০২ জুলাই বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কিছু দূরে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নেতৃত্ব দেয়া রাবি ছাত্রলীগ নেতাদেরকে চিহ্নিত করেছে যুগান্তর। অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।
হামলায় আহত হন কোটা আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম তারেক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগ নেতারা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার পায়ের দুটি হাড় ভেঙে দেয়।
তারেক বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
গুরুতর আহত তারেকের শারীরিক অবস্থার বর্তমানে আরও অবনতি ঘটেছে। শনিবার দুপুরের পর তার আট থেকে দশবার বমি হয়েছে। বেশির ভাগ সময় তার জ্ঞান থাকছে না বলে জানিয়েছেন তারেকের বোন ফাতেমা খাতুন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গত ৫ জুলাই ‘জোরপূর্বক ছাড়পত্র’ দেয়ার পর বর্তমানে নগরীর রয়েল হাসপাতালের ৬০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন তারেক।
এদিকে ২ জুলাই হামলা চালানোর আগে গত ০১ জুলাই রোববারও কোটা আন্দোলনকারীরা মানববন্ধন করতে গেলে তাদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ।
দুই দিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী, হামলার ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাবি ছাত্রলীগের ১০-১৫ জন নেতাকর্মী এ হামলায় মূল ভূমিকা পালন করে।
ছাত্রলীগের রাবি শাখার সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু এ দুই হামলার নেতৃত্বে থাকলেও আক্রমণ ও মারধরের ক্ষেত্রে তাদের দেখা যায়নি। কয়েকজন সহ-সভাপতি, সংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন আক্রমণের নেতৃত্বে।
রোববার কোটা আন্দোলনকারীদের আক্রমণে নেতৃত্বে দেখা গেছে লতিফুল কবির মানিক নামের একজনকে। রামদা হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া মানিক নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তিনি ইতিহাস বিভাগে মার্স্টাসের ছাত্র এবং ছাত্রলীগকর্মী।
এরপরই হাতুড়ি হাতে আক্রমণে দেখা গেছে আবদুল্লাহ আল মামুনকে। তিনি রাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
এরপর আক্রমণে দেখা যায় রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশুকে। যিনি বাঁশের লাঠি হাতে কোটা আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
এদের পর আক্রমণে মূল ভূমিকায় আরও দেখা গেছে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি গোফরান গাজী, মিজানুর রহমান সিনহা, রমিজুল ইসলাম রিমু, সাদ্দাম হোসেন, আহমেদ সজীব, ছানোয়ার হোসেন সারোয়ার, আরিফ বিন জহির, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরুল জামিল সুস্ময়, হাসান লাবন, ইমতিয়াজ আহমেদ, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিব, কর্মী জন স্মিথ ও রাশেদ খান।
এরা সবাই রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি নিয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া ও মারধর করেন। তবে আক্রমণের একপর্যায়ে এদের মধ্যে কয়েকজনকে আবার মারধরকারীদের ঠেকাতেও দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার (০২ জুলাই) বিকেল সোয়া ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে পতাকা মিছিল বের করলে সেখানে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারীদের পতাকা কেড়ে নিয়ে ১০-১৫ জন নেতাকর্মী রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে হামলা করে। এসময় পুলিশ দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ছিল বলে অভিযোগ করে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এর আগে রোববার (০৩ জুলাই) সকাল পৌনে ১০টা এবং পরে বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা মানববন্ধনের প্রস্তুতিকালে তাদের ওপর দুই দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এসময় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেওয়া হয় এবং কয়েকজনকে চড়-থাপ্পড় ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাবি শাখার আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফ বলেন, ‘আমাদের দুই দিনের কর্মসূচিই শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলায় আহত আমাদের পরিষদের রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম তারেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
এদিকে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করলেও ধাওয়া দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের নামে জামায়াত-শিবির ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিল। ক্যাম্পাসে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে আমরা তাদের প্রতিহত করেছি। তাদের ওপর কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, কোটা আন্দোলনকারীরা এখন আর কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই। তারা এখন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে গিয়ে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এজন্য ক্যাম্পাসে কোন ধরনের কর্মসূচি করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।