মুসাফির রাফি
সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, এই স্বাধীন দেশটিতে সবচেয়ে বেশী এখন মানবিক মর্যাদাকেই ভুলুন্ঠিত করা হয়। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নুরকে তার ন্যায্য কথা বলার দায়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে চায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ তাকে তুলে নিতে চায় কিংবা পুলিশের ধমকানিতে ভয় পেয়ে একজন রোগীকে মাঝরাতে চিকিৎসা না দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বের করে দিতে চায়- এসবই এখন হচ্ছে বাংলাদেশে।
কিংবা একজন ছাত্র যখন পুলিশের ভয়ে তাড়া খেয়ে বেড়ায়, ফেসবুক লাইভে এসে মানুষের কাছে সাহায্য ভিক্ষা চায়, তখন তার অসহায়ত্ব, চোখের পানি, মুখের ঘাম আমাদের স্বাধীনতার দিকে যেন বার বার প্রশ্ন উত্থাপন করে আর বলে এমন স্বাধীনতাই কি আমরা চেয়েছিলাম?
এতো গেলো গত দুদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের চালচিত্র। কিন্তু দেশের অন্য সব নাগরিকের অবস্থাটাই বা কি?
সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে চলতি বছরের ১ জানুয়ারী থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে ২৭৫ জন মানুষ পুলিশের সাথে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে, ক্রসফায়ারে এবং পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছে।
৬ মাসে ২৭৫ জন মানুষ হত্যা!! যুদ্ধ বা সংঘাত চলছে এরকম দেশে এ সংখ্যা স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশে এমন সংখ্যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এ ২৭৫ জন মানুষ কোন বহি:শত্রুর আক্রমনে নয়, এদেরকে নিজ দেশের আইনশৃংখলা বাহিনী, আইনের ব্যাখ্যা ও দোহাই দিয়েই হত্যা করেছে।
একই সঙ্গে প্রতিবেদনে জানানো হয়, একই সময়ে ৪২৭ মহিলা নানাভাবে ধর্ষনের শিকার হয়েছে। এছাড়া সীমান্তে ৩০ জন বাংলাদেশী নাগরিক এই সময়ে ভারতীয় বিএসএফ এর হাতে নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৯ জন আর বিএসএফ অপহরন করেছে আরও ৮ বাংলাদেশীকে।
আসক তাদের প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক কেননা গত ৬ মাসে যেভাবে বিচারবহির্ভুত হত্যা বেড়েছে তা নজিরবিহীন। ধর্ষন ও নারী নির্যাতনের মাত্রাও যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশী।
শুধু মাদক দমনের নামে গত ১৫ মে থেকে ৩০ জুন সময় অবধি আইনশৃংখলা বাহিনী ১৭৬ জন মানুষকে হত্যা করেছে। বিগত ৬ মাসে যে ২৭৫ জন মানুষকে বিচারবহির্ভুত উপায়ে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে ৬৬ জন নিহত হয়েছেন র্যাবের সাথে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে, পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে আরো ১৪১ জন, ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৩১ জন আর নৌ পুলিশ হত্যা করেছে আরো ১ জনকে।
একই সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ১৮টি গুলিবিদ্ধ লাশও উদ্ধার করার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুলিশী হেফাজতে আত্মহত্যা করেছে একজন আর কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় পুলিশের নির্যাতনের কারনে ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া একই সময়ে কারাগারে থাকা ২২ জন কয়েদী এবং অন্য ২৮ জন আসামী মারা গেছে বলে আসকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
অন্যদিকে যে ৪২৭ জন নারীকে ধর্ষন করা হয় তার মধ্যে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জন নারীকে, আর আরো ৩ জন নিজেরাই আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া যৌন হয়রানির কারনে আরো ৫৮ জন নারী এই সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন আরো ৬৯ জন নারী।
শুধু বয়স্ক মানুষই নয় বরং ৮৫৬ জন শিশুও একই সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৮ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ৫৮ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে, অপহরনের পর লাশ পাওয়া গেছে ৬১ জন শিশুর।
এই ৬ মাসের মধ্যেই ৯০ জন সাংবাদিককে নানাভাবে নির্যাতন, শারীরিক লাঞ্ছনা ও হুমকি দেয়া হয়েছে। তাদেরকে পেশাগত কাজ করার সময় বাধা দেয়া হয়েছে বলে আসকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
এই বাস্তবতা কিভাবে একটি স্বাধীন দেশে হয়? মানবতার জয়গান গাওয়া একটি দেশে কিভাবে এতটা অমানবিকতার চর্চা হয়? এই সরকার দেশকে মানবাধিকারের যে তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে তাতে এ কথা বলতেই হয়, বেঁচে যে আছি এখনো, এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি আমাদের।